জাহিদ হাসান: নেত্রকোণার কলমাকান্দা উপজেলার বিশরপাশা ও সংলগ্ন অন্তত পনেরটি গ্রামের বিস্তির্ণ এলাকাজুড়ে চোখ জুড়ানো হলুদের সমারোহ- সরিষার ক্ষেত। এসব ক্ষেতের কাছাকাছি স্থানে সারিবদ্ধভাবে বিশেষ-বাক্স স্থাপন করে শাহ আলম গড়ে তুলেছেন বিশাল আকারের মৌ-খামার। না দেখলে বিশ্বাস করার উপায় নেই যে, এই খামার থেকে তিনি প্রতি বছর উৎপাদন করেন ৭ হাজার ১৫০ লিটার (৭ মেট্রিক টন ১ শ’ ৫০ কেজি) মধু।
খরচ বাদে আয় করেন ১৪ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা। শুধু তাই নয়, মধু উৎপাদন খামার পরিচালনা করে নিজের ভাগ্য উন্নয়নের পাশাপাশি অনেকের কর্মসংস্থান করেছেন তিনি। পাশাপাশি তাকে অনুসরন করে মধু উৎপাদন খামার গড়ে তুলার কথাও ভাবছেন এলাকার অনেকেই। কৃষি অধিদপ্তরের সহযোগিতায় চলতিবছর অধিক পরিমাণ জমিতে সরিষার চাষ হয়ছে। ফলে অন্যবছরের তুলনায় এবার মধু উৎপাদনও বেশি হবে বলে আশা করছেন সবাই।
নেত্রকোণার বারহাট্টা উপজেলার মধুপুর গ্রামের বাসিন্দা শাহ আলম। নারায়নগঞ্জের একটি প্রিন্টিং কোম্পানিতে চাকরি করতেন তিনি। করোনা অতিমারীর সময় তিনি চাকরি হারিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। পরে স্থানীয় বিসিক থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০২০ সালে পরিক্ষামূলকভাবে মাত্র ৫টি কলোনি (মৌবাক্স) দিয়ে শুরু করেন মধুচাষ। প্রথম বছরে তার আয় হয় ৫০ হাজার টাকা। এর পর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
শাহ আলম বলেন, ‘সারাবছর আমি মধু উৎপাদনের কাজ নিয়েই থাকি। যেখানেই ফুল-ফসল সরিষা, লিচু, ধনে কালোজিরা ও সূর্যমুখীর জমি, উপকরণাদি নিয়ে সেখানেই চলে যাই। মধু উৎপাদন করি।’
তিনি জানান, মধুর বাজারজাত করাও অনেকটা সহজ। পাইকারী বাজার উঠানামা করলেও খুচরা বাজারে বেশ সুবিধা পাওয়া যায়। প্রতিটি কলোনি থেকে গড়ে ৫৫ কেজি মধু পাওয়া যায়। তার ১৩০টি কলোনী আছে। বছরে দুবার মধু পাওয়া যায়। খরচ বাদে প্রতি মৌসুমে তার আয় হয় প্রায় ৭ লক্ষ টাকা। অল্প পুঁজিতে একটা শিল্প গড়ে তুলতে পেরেছেন, এটা তার কাছে বড় পাওয়া।
এখন তিনি পরিণত হয়েছেন একজন আদর্শ পরামর্শকে। বর্তমানে তাকে অনুসরন করে জেলায় মধু সংগ্রহের পেশায় যুক্ত রয়েছে প্রায় ১৫ জন শিক্ষিত যুব-তরুণ। যাদের হাতে পাল্টে গেছে মধূ আহরনের হাজার বছরের পুরানো ধ্যান-ধারনা। মধুচাষ বা আহরণ এখন একটি শিল্প। ফলে জেলায় মধু চাষে উৎসাহী হচ্ছেন অনেকেই। তারা পরামর্শের জন্য শাহ আলমের কাছে আসেন। শাহ আলমও চেষ্ঠা করেন সাধ্যমত সহযোগিতার।
মধুচাষী মো: শামছুল হক জানান, শাহ আলম ভাইয়ের দেখাদেখি বাক্সে মধুচাষ শুরু করেছিলাম। সফলতা পেয়েছি। এতে আরো অনেকেই উদ্যোগী হয়েছেন।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) নেত্রকোণার উপব্যবস্থাপক মো: আক্রাম হোসেন বলেন, মৌমাছিকে তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে এনে মৌচাকের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বাক্সে পালন করা হয়। এই বাক্সেই মধু সঞ্চয় করে মৌমাছির দল। তবে প্রশিক্ষণ ছাড়া এই কাজ করতে গেলে বিপদ হতে পারে। শাহ আলম বিসিক থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তিনি একজন সফল মৌচাষী।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, নেত্রকোণার উপপরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ নুরুজ্জামান বলেন, এভাবে মধুর চাষ করায় পরাগায়নের মাধ্যমে ফসলও ভালো হয়। উৎপাদন বাড়ে অন্তত স্বাভাবিকের চেয়ে ২০ গুণ বেশী। ব্যক্তি বা উদ্যোক্তাও যথেষ্ট লাভবান হয়। এক্ষেত্রে শাহ আলম অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
তিনি আরও বলেন, অনেক আশা নিরাশার পথ পেরিয়ে মৌচাষীরা এখন সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। দেশে মধুর চাহিদা এবং বাজার বৈশিষ্ট গুলো মানুষ মূল্যায়ণ করতে শিখেছে। বিষয়গুলো ইতিবাচক। আরও ইতিবাচক বিষয় হলো শাহ আলমের মতো শিক্ষিত সচেতন এবং সুক্ষদর্শী তরুণ উদ্যোক্তারা মৌচাষে এসছে। তারা এই শিল্পে সম্ভাবনার জায়াগাগুলো নতূন করে তোলে আনতে পারছে। মধুর আহরণ পাদনীর ভেতরে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলো গভীরভাবে উপলদ্ধি করছে। তাদের অনুসন্ধানী মন আরও বিশ্বাস এবং আন্তরিকতা মৌচাষ শিল্প বহুদূর এগিয়ে যাবে আমাদের বিশ্বাস।