দীর্ঘদিন সিকিউরিটি গার্ডের চাকরির সুবাদে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে পারে আব্দুল কুদ্দুস ওরফে ডলার নাহিদ।
নিজেকে গোয়েন্দা শাখা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মিথ্যা পরিচয় দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযানের নামে বিভিন্ন বাড়ি থেকে তল্লাসীর সময় নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার ও মূল্যবান সামগ্রী লুট করত।
বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথে সখ্যতা গড়ে তুলত এবং অনেক ক্ষেত্রে সে প্রতারণার মাধ্যমে কৌশলে প্রশাসনের সহায়তা নিত।
বুধবার ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর মিরপুর থেকে ডলার নাহিদকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-৪। সেসময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভুয়া পরিচয়পত্র এবং প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক পরিহিত ছবি জব্দ করা হয়।
বীর মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে লুট
গত ২৫ জানুয়ারি সুনামগঞ্জ সদরের নারায়নতলা গ্রামের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোকসেদ আলীর বাড়িসহ বেশ কয়েকটি বাড়িতে গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পরিচয়ে তল্লাসী, শ্লীলতাহানি, লুটের চেষ্টাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভুয়া পরিচয়ে অভিযানের নামে অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রী আত্মসাৎ করে আব্দুল কুদ্দুস ওরফে ডলার নাহিদ।
সেসময় অভিযানের নামে বেশ কয়েকটি বাড়িতে লুটপাট চালায় এবং বেআইনীভাবে তল্লাশির নামে গৃহবধূর শ্লীলতাহানীর ঘটনা ঘটায়।
ভুক্তভোগীর বাদী হয়ে মামলা
ওই ঘটনায় ভুক্তভোগী বাদী হয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখ সুনামগঞ্জ মডেল থানায় পরে সংশ্লিষ্ট থানা আসামিদের গ্রেপ্তারে র্যাবের সহায়তা চাইলে র্যাব মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি আসামি বিজন রায়কে মিরপুর মডেল থানার এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-৪। বিজনের মাধ্যমে র্যাব জানতে পারে সুনামগঞ্জের বর্ণিত এলাকার বিভিন্ন বাড়িসহ বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে গোয়েন্দা সংস্থার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মিথ্যা পরিচয় দিয়ে লুটপাট এবং চাঁদাবাজির মূল পরিকল্পনাকারী আব্দুল কুদ্দুস ওরফে ডলার নাহিদ। তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব ডলার নাহিদ’কে খুঁজতে নজরদারী বৃদ্ধি করে এবং বিজন এর দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব বুধবার রাতে রাজধানীর মিরপুর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে গ্রেপ্তার করে।
ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপ থেকে অর্থ আত্মসাৎ
বৃহস্পতিবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, ডলার নাহিদ বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপে মানুষের কাছে নিজেকে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে মিথ্যা পরিচয় দিত।
সে প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডি পেরিয়েছে এবং ২০০৯ সালে তার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা থাকলেও সে নিজেকে ১৯৯৬ সালের এসএসসি ব্যাচ দাবি করে। বিভিন্ন কৌশলে এই ব্যাচের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গ্রুপে যুক্ত হয়ে নিজেকে গোয়েন্দা শাখা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন সময় প্রতারণা করেছে।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সখ্যতা
র্যাব বলছে, গত চার-পাঁচ মাস আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি গ্রুপের মাধ্যমে ডলার নাহিদের সঙ্গে বিজনের পরিচয় হয়। রাজধানীতে বিজনের সাথে দেখা করার পাশাপাশি বিজনের বাড়ি সুনামগঞ্জে হওয়ায় সে সুনামগঞ্জ যায়।
গ্রেপ্তার বিজন সুনামগঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তদের সাথে তার সু-সম্পর্ক ছিল। পরে বিজনের সাথে সুনামগঞ্জে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের কাছে কৌশলে নিজেকে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় প্রদান করে ডলার নাহিদ।
পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানান যে এখানে সে মাদকের একটি চালানের বিরুদ্ধে অভিযান করতে এসেছেন এবং অভিযানের জন্য তাদের সহায়তা চায়। সেসময় সে বিজন ও অন্যান্য সহযোগীদের সমন্বয়ে সুনামগঞ্জের সদর থানাধীন নারায়ণতলা এলাকায় বিভিন্ন বাড়িতে লুটের জন্য পরিকল্পনা করে। প্রথমত তারা লুটের উদ্দেশ্যে উক্ত এলাকায় বিত্তশালী কয়েকটি বাড়ি টার্গেট করে এবং তিন দিন ধরে টার্গেট বাড়ি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে ও বিভিন্নভাবে পর্যবেক্ষণ করে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখ রাতে ঘটনাস্থলে যান। পরে সে স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে সমন্বয়ের কথা জানিয়ে তাদের ঘটনাস্থলে আসতে বলে। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক নিজেকে গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে তারা বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক চেয়ারম্যান মো.মোকসেদ আলী বাড়ীসহ আশেপাশের বাড়িতে তল্লাশি করে এবং বাড়িতে থাকা লোকজনের শ্লীলতাহানী করে। এসময় তারা তল্লাশী কার্যক্রম পরিচালনা করে নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী হাতিয়ে নেয়। ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে তারা অভিযান শেষ করে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগের চেষ্টা করে। একপর্যায়ে স্থানীয় লোকজন তাদের আটক করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সংবাদ দেয়। সেসময় সে নিজেকে গোয়েন্দা শাখার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মিথ্যা পরিচয় দিয়ে কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে যায়।
র্যাব জানায়, ডলার নাহিদ গত পাঁচ-ছয় বছর যাবত ঢাকা ও পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গোয়েন্দা সংস্থার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে ভুয়া পরিচয় দিয়ে অভিযানের নামে বিভিন্ন বাড়ি হতে নগদ অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রী লুট করেছে।
সিকিউরিটি গার্ড থেকে প্রতারক চক্রের হোতা
কমান্ডার মঈন জানান, আব্দুল কুদ্দুস ওরফে ডলার নাহিদ ঢাকা জেলার একটি স্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। সে ২০১৬ সালে ঢাকায় একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে সিকিউরিটি গার্ডের চাকুরী নেয়। সিকিউরিটি গার্ডে চাকরির সুবাদে সে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের সাথে পরিচয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে পারে। এসকল কার্যক্রমকে রপ্ত করে গত পাঁচ-ছয় বছর যাবৎ নিজেকে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খল বাহিনীর একজন কর্মকর্তা হিসেবে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতারণা করত। এরআগেও সে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মিথ্যা পরিচয় দিয়ে হুমকি দিলে র্যাবের কাছে গ্রেপ্তার হয়ে বেশকিছুদিন কারাভোগ করে।