নির্মাতার মৃত্যুও থামাতে পারেনি ‘কালবেলা’র যাত্রা
ডিসেম্বরে মুক্তি পাচ্ছে ‘আধিয়ার’ নির্মাতা সাইদুল আনাম টুটুলের স্বপ্নের ছবি ‘কালবেলা’
‘আধিয়ার’ খ্যাত নির্মাতা সাইদুল আনাম টুটুলের স্বপ্নের ছবি ‘কালবেলা’। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই ছবিটি নিজের মতো করে নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন তিনি। সব ঠিক ছিলো, ২০১৮ সালে শুটিং শুরু করে প্রায় শেষও করেছিলেন তিনি। কিন্তু পুরো ছবি সম্পূর্ণ করার আগেই মারা যানা এই গুণী নির্মাতা।
তাই বলে কি নির্মাতার স্বপ্নের কাজটি থেমে যাবে, আলোর মুখ দেখবে না? তা কি হয়? না, তেমনটা হতে দেয়নি তার পরিবার। সেইসঙ্গে যারা তারসঙ্গে নিয়মিত কাজ করেছেন, সবার সহায়তায় শেষ হয়েছে ‘কালবেলা’ চলচ্চিত্রের সমস্ত কাজ।
নির্মাতার মৃত্যুর পর পুরো জার্নিটার নেতৃত্বে ছিলেন সাইদুল আনাম টুটুলের স্ত্রী ও এই ছবির প্রযোজক মোবাশ্বেরা খানম। নির্মাতা স্বামীর রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজটি সম্পন্ন করেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে। যা দর্শকের সামনে হাজির হতে চলেছে ডিসেম্বরের ১৫ তারিখের মধ্যেই!
‘কালবেলা’ চলচ্চিত্রের নির্বাহী প্রযোজকদের একজন হুমায়ুন কবীর শুভ। ছবিটির মুক্তি প্রসঙ্গে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, ডিসেম্বরে আমরা মুক্তি নিশ্চিত করেছি। এরমধ্যে সিনেপ্লেক্স ও ব্লকবাস্টার সহ চট্টগ্রামের একটি সিনেমা হলের সাথে কথা হয়েছে। চূড়ান্ত হলেই আমরা মুক্তির তারিখ ও সিনেমা হলের সংখ্যা জানাতে পারবো।
নির্মাতার মৃত্যুর পর ‘কালবেলা’ শেষ করতে কি বেগ পেতে হয়েছে? এমন প্রশ্নে এই ছবির নির্বাহী প্রযোজক জানান, না, আমাদের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি, কারণ পরিকল্পনা মাফিক ‘কালবেলা’র ক্যামেরার কাজ তিনি সম্পন্ন করে গিয়েছিলেন, শেষ দিকে আমরা শুধু দু’একদিন প্যাচওয়ার্ক করেছি। তাও উনার তৈরী করা স্টোরি লাইন দেখেই সেটা করেছি।
তিনি বলেন, নির্মাতা সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে গেছেন। স্ক্রিপ্ট থেকে শুরু করে সবকিছু গুছানো ছিলো। তিনি সব সময় ভিজ্যুয়ালাইজ করতেন আর সেটা লিখে রাখত। তার স্টোরি বোর্ড দেখে দেখে যে কারো দ্বারা সিনেমা বানিয়ে ফেলা সম্ভব। তাছাড়া টুটুল ভাইয়ের সিনেমা যাত্রার সাথে শুরু থেকেই উনার সহধর্মিনী সঙ্গে ছিলেন, ফলে ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে বাকি কাজটুকু তারজন্য করে ফেলা সম্ভব হয়েছে।
এরইমধ্যে ‘কালবেলা’র ট্রেলার দেখে বহু প্রশংসা পাচ্ছেন বলেও জানান শুভ। জানালেন, অনেকেই ‘কালবেলা’র ট্রেলার দেখে তাদের ভালো লাগা এবং ছবিটি নিয়ে তাদের আগ্রহের কথা জানাচ্ছেন। তবে সবচেয়ে আনন্দের বিষয়টি হলো, ‘কালবেলা’র ট্রেলার দেখে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর থেকে আমাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা নিজ উদ্যোগে ‘কালবেলা’র বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করতে চান। সেটা হয়তো ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই হবে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরের সরকারি অনুদানের ছবি ‘কালবেলা’। ছবির গল্প ২০০১ সালে আইন ও সালিশ কেন্দ্র কর্তৃক প্রকাশিত নারীর ৭১ ও যুদ্ধপরবর্তী কথ্যকাহিনি থেকে নেওয়া। চলচ্চিত্রটির প্রধান দুই চরিত্র মতিন ও সানজিদা। মতিন চরিত্রে অভিনয় করেছেন শিশির আর সানজিদা চরিত্রে তাহমিনা অথৈ। পরিচালকের নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা ‘আকার’ থেকে ছবিটি নির্মিত হয়েছে।
এক নজরে সাইদুল আনাম টুটুল:
২০১৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর অনন্ত যাত্রায় পাড়ি জমানো সাইদুল আনাম টুটুল ১৯৫০ সালের ১ এপ্রিল পুরোনো ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব কৈশোর থেকেই তিনি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত থেকেছেন। ছাত্রজীবনে তিনি ঢাকা সরকারি মুসলিম স্কুল থেকে ১৯৬৭ সালে মাধ্যমিক এবং পরে ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৭১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন।
মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন সাইদুল আনাম টুটুল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন এবং ৬ নম্বর সেক্টরের আওতায় খুলনা অঞ্চলে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন টুটুল। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ততার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ১৯৭৪ সালে ভারতের আইসিসিআর বৃত্তি নিয়ে পুনার চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে চলচ্চিত্র সম্পাদনা অধ্যয়ন করতে চলে যান। চলচ্চিত্র সম্পাদনার উপর পড়াশোনা শেষ করে তিনি ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
বাংলাদেশে ফিরে সাইদুল আনাম টুটুল বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচিত ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ চলচ্চিত্রের সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৯ সালে ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ চলচ্চিত্রের সম্পাদক হিসেবে তিনি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র সম্পাদকের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। চলচ্চিত্র সম্পাদক হিসেবে তিনি ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ ছাড়াও সম্পাদনা করেন সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী নির্মিত ‘ঘুড্ডি’, শেখ নিয়ামত আলী নির্মিত ‘দহন’, মোরশেদুল ইসলামের ‘আগামী’, ‘দুখাই’, ‘দীপু নাম্বার টু’র মতো ক্লাসিক চলচ্চিত্র।
চলচ্চিত্র সম্পাদনার দায়িত্ব পালন ছাড়াও তিনি ছিলেন একজন চলচ্চিত্র শিক্ষক। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট, বিভিন্ন চলচ্চিত্র সংসদের আয়োজনে ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স ও চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রশিক্ষণ কর্মশালায় তিনি চলচ্চিত্র ভাষা ও চলচ্চিত্র সম্পাদনা বিষয়ে পাঠদান করতেন।
সাইদুল আনাম টুটুল বাংলাদেশে টেলিভিশন ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নাটকের নির্মাতা। তার উল্লেখযোগ্য টেলিভিশন নাটকগুলো হলো নাল পিরান, বখাটে, সেকু সেকান্দর, ৫২ গলির এক গলি, আপন পর, গোবর চোর, হেলিকপ্টার, নিশিকাব্য, অপরাজিতা ইত্যাদি। সাইদুল আনাম টুটুল বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণের ধারায় প্রভূত পরিবর্তন আনেন। তিনি প্রায় চার শতাধিক বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ করেছেন।