প্রতিটি খেলোয়াড়ের সাথেই এমন কিছু না কিছু ঘটেছে, সমাজের বঞ্চনা-গঞ্জনা সইতে হয়েছে বিস্তর। বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের সেই খেলোয়াড়রা এখন বড় তারকা। নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি দেশকে এনে দিচ্ছেন সম্মানের উপলক্ষ, গর্বের ইতিহাস। নানা তীর্যকবাণ এড়িয়ে তাদের এতদূর আসতে হয়েছে। সব সয়েই হৃদয়ে ছিল শিরোপার প্রত্যয়।
সাফজয়ী ফুটবলাররা প্রত্যেকেই এখন হয়ে উঠেছেন দেশের মানুষের নয়নের মণি। তাদের একজন মিডফিল্ডার সানজিদা আক্তার। ময়মনসিংহের কলসিন্দুর গ্রাম থেকে উঠে আসা ২১ বর্ষী তারকা নিজ এলাকায়ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন। কিশোর-কিশোরীরা বড় হয়ে সানজিদার মতো ফুটবলার হতে চাচ্ছেন। উঁচিয়ে ধরতে চাচ্ছেন বড় বড় ট্রফি।
ফাইনালের আগে সানজিদা আক্তার আক্ষেপ আর আবেগ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে পোস্ট দিয়েছিলেন, সেটি সবার স্মৃতিতে এখনও টাটকা।
লিখেছিলেন, ‘ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে না দাঁড়ালেও চলবে, সমাজের টিপ্পনীকে একপাশে রেখে যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করেছে, তাদের জন্য এটি জিততে চাই। আমাদের এই সাফল্য হয়তো আরো নতুন কিছু সাবিনা, কৃষ্ণা, মারিয়া পেতে সাহায্য করবে। অনুজদের বন্ধুর এই রাস্তাটুকু কিছু হলেও সহজ করে দিয়ে যেতে চাই।’
সানজিদার আবেগের সঙ্গে মিশে একাকার হয়েছিল সাধারণ মানুষের আবেগ। যার ফলে ট্রফি নিয়ে উৎসবে মেতেছিল পুরো দেশ। ছাদখোলা বাসেই সংবর্ধনা পেয়েছিলেন সাফজয়ী বীরকন্যারা।
সাহসিকতা আর দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে শুধু শিরোপাই জেতেননি, দেশের মানুষের ভালোবাসাও জিতে নিয়েছে জয়ী মেয়েরা। সানজিদার কাছে এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
চ্যানেল আইকে সাক্ষাৎকারে সেই আবেগী পোস্ট প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘যেখানে থেকে বড় হয়েছি, চারপাশের পরিবেশ দেখেছি। এখনো আবার বন্ধু যারা আছে, তাদের সবই আমি দেখেছি। তারপরই আমার মনে হয়েছে এরকম একটা কথা বলা দরকার ছিল। এটা আসলে অবিশ্বাস্য। কখনো কল্পনা করিনি আমার এই ছোট্ট একটা লেখা এতদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যাবে। দেশের মানুষ এতো সাড়া দেবে।’
নিজ শহর ময়মনসিংহ আর এলাকা কলসিন্দুরের উন্নয়নে সানজিদাদের রয়েছে বড় ভূমিকা। সেখানে অনুপ্রেরণার বড় নামও সানজিদা। অথচ প্রবল সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে তাকে আজকের অবস্থানে আসতে হয়েছে। নিজ মুখেই করলেন অতীতের সেসব স্মৃতিচারণ।
‘আগে যখন প্রথম খেলা শুরু করি, অনেকের অনেক বাজে কথা আমাকে শুনতে হয়েছে। আমার পরিবারকে শুনতে হয়েছে। অনেক কষ্ট সহ্য করে এ পর্যন্ত এসেছি। যখন তাদেরকে সফলতা এনে দিয়েছি, তারপর তাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা আস্তে আস্তে বদলে যেতে শুরু করেছে।’
ফুটবল মাঠে ভালো পারফর্ম করেই ক্ষান্ত হননি কলসিন্দুর থেকে উঠে আসা সানজিদাসহ বাকিরা। জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে এলাকার উন্নয়নেও রেখেছেন বড় অবদান।
সানজিদা বললেন, ‘আমাদের এলাকার জন্য আমরা অনেককিছু করেছি। আমাদের স্কুল-কলেজ সরকারীকরণ করে দিয়েছি। আমাদের রাস্তাঘাট উন্নয়ন, তারপর ৮০০ পরিবারের বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছি। সবমিলিয়ে আমাদের অনেকেই এখন সমর্থন করে।’
জনপ্রিয়তায় গা না ভাসিয়ে নিজের কাজটা ঠিকঠাক চালিয়ে যেতে চান সানজিদা। জয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে এগিয়ে যেতে চান, ‘অনেকেই বলে যে আমার মতো হতে চায়। অনেকে আবার বাংলাদেশের রোল মডেল বলে। এ জায়গা থেকে বলবো যে আসলে আমি কিছুই না। আমার জুনিয়র যারা আছে তারা যদি ভালো করে চেষ্টা করে, আমার চেয়ে ভালো কিছু হতে পারবে।’