চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ইউক্রেন প্রশ্নে কি হোঁচট খেলেন পুতিন?

ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বিতর্কে এ বার রাশিয়ার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করতে ভারত এবং চীন কি সক্রিয় হয়েছে? তেমনই মনে করছেন কূটনীতি বিশ্লেষকদের একাংশ।

তাদের মতে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বৈঠকে সেই ইঙ্গিতই মিলেছে। বিশ্বের প্রথম ও দ্বিতীয় জনবহুল দুই দেশের রাষ্ট্রনেতারা এ ক্ষেত্রে ‘সাবধানী পদক্ষেপ’ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন বলেই মনে করা হচ্ছে।

উজবেকিস্তানের সমরখন্দে সাংহাই কোঅপারেশনের শীর্ষ সম্মেলনের পার্শ্ববৈঠকে শুক্রবার পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে মোদি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, এখন যুদ্ধের সময় নয়। এই আপৎকালীন সময়ে খাদ্য ও শক্তির নিরাপত্তার বিষয়টিরই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। চলতি সপ্তাহের শুরুতেই ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধের সম্ভাবনা খারিজ করেছিলেন পুতিন। বরং আক্রমণের তীব্রতা আরও বাড়ানোর বার্তা দিয়েছিলো মস্কো। এই পরিস্থিতিতে মোদির মন্তব্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে রুশ প্রেসিডেন্টের ‘নিঃসঙ্গতা’ স্পষ্ট করেছে বলেই মনে করা হচ্ছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে পুতিনের সঙ্গে চার বার ফোনে কথা বলেছেন মোদি। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ভারতে সফরে এসেছেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভও। শুক্রবারের বৈঠকে মোদি সেই প্রসঙ্গ তুলে পুতিনকে বলেছেন, গণতন্ত্র, কূটনীতি এবং আলোচনাই বর্তমান বিশ্বে সমস্যা সমাধানের পথ হওয়া উচিত। যার জবাবে ‘তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে’ নয়াদিল্লির উদ্বেগের বিষয়টি মেনে নিয়েছেন পুতিন। মোদিকে জন্মদিনের আগাম শুভেচ্ছা জানিয়ে যত দ্রুত সম্ভব সঙ্ঘাতে ইতি টানার কথা বলেছেন। গত আট মাস ধরে এক বারের জন্যও এমন ‘শান্তির বাণী’ শোনা যায়নি রুশ প্রেসিডেন্টের মুখে।

ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকেই ভারসাম্যের কূটনীতিতে অবিচল থেকেছিল ভারত। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ, সাধারণ সভা এবং মানবাধিকার পরিষদে ইউক্রেনে রুশ হামলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর আনা একাধিক প্রস্তাবে ভোটদান থেকে বিরত থাকে মোদি সরকার।

জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি টি এস তিরুমূর্তি সে সময় বলেছিলেন, ইউক্রেনের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে ভারত গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন। অবিলম্বে বৈরিতা এবং হিংসা বন্ধের আবেদন জানাচ্ছি আমরা। কিন্তু সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক সংহতিকে সম্মান করাই ভারতের নীতি।

কিন্তু আন্তর্জাতিক জনমত এবং পশ্চিমা চাপে মার্চের শেষে যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে নয়াদিল্লীর সুর ধীরে ধীরে চড়তে শুরু করে। প্রথমে দ্য হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সেনা অভিযান বন্ধের দাবিতে আনা প্রস্তাব সমর্থন করেন ভারতের প্রতিনিধি বিচারপতি দলবীর ভান্ডারী। এর পর আগস্টে ইউক্রেনে রুশ হামলার নিন্দা করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আনা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় ভারত।

সোভিয়েত জমানার পতনের পর মস্কো-ওয়াশিংটন ঠান্ডা যুদ্ধের পালা শেষ হলেও ইউক্রেন পরিস্থিতির জেরে রাশিয়া এখন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু। আবার গত কয়েক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব বেড়েছে ভারতের। সামরিক এবং বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক নির্ভরতাও তৈরি হয়েছে। কিন্তু ইউক্রেন পরিস্থিতির পর রাশিয়ার যে কোনও মিত্রদেশই এখন যুক্তরাষ্ট্রের চক্ষুশূল। এই পরিস্থিতিতে পররাষ্ট্রনীতির ভারসাম্য বজায় রাখাটাই মোদি সরকারের বড় ‘চ্যালেঞ্জ’ বলে মনে করছিলেন কূটনীতি বিশেষজ্ঞদের একাংশ। এই পরিস্থিতিতে সমরখন্দে মোদির বার্তা আগামী দিনে মস্কোর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করতে পারে বলে তাদের অভিমত।

বস্তুত, মোদির সঙ্গে আলোচনার আগে সমরখন্দে জিনপিংয়ের সঙ্গে পার্শ্ববৈঠকেই পুতিনের ওই নিঃসঙ্গতা স্পষ্ট হয়েছিল। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পুতিনবাহিনীর অভিযান শুরু পর মস্কোর পাশে থাকলেও সমরখন্দের আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইউক্রেনে হানাদারির পক্ষে একটিও কথা বলেননি চীনা প্রেসিডেন্ট। বরং পুতিনের পাশে দাঁড়িয়ে ‘আন্তর্জাতিক অস্থির পরিস্থিতিতে শান্তি ও সুস্থিতি ফেরানোর পক্ষে প্রশ্ন করেছিলেন।

ঘটনাপ্রবাহ বলছে, গত ছয়মাসে বেইজিংয়ের মস্কো-নীতিও অনেকটাই বদলে গেছে। এখনও পর্যন্ত জাতিসংঘে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিটি প্রস্তাবের ক্ষেত্রেই ভোটদানে বিরত থেকেছে চীন। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত মার্চে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলির জি-২০ থেকে রাশিয়াকে বহিষ্কারের উদ্যোগ নেয়ায় জিনপিং সরকার সরাসরি তার বিরোধিতা করেছিল। পাশাপাশি, মস্কোর বিরুদ্ধে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞারও সমালোচনা করেছিল চীন।

কিন্তু সাম্প্রতিক তাইওয়ান সঙ্কটের পর ইউক্রেন থেকে চীনের ‘নজর’ অনেকটাই সরে গিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এমনকি, যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিরক্ষা পর্যবেক্ষক সংস্থার সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধে অস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জামের ঘাটতি মেটাতে উত্তর কোরিয়ার মতো দেশ রাশিয়াকে সাহায্য করলেও এড়িয়ে গিয়েছে চীন।

প্রসঙ্গত, সমরখন্দের আগে শেষ বার বেইজিংয়েই পুতিন-জিনপিং বৈঠক হয়েছিল। ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে উত্তেজনার সেই আবহে রাশিয়ার পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিয়ে চীনা প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, ‘রুশ-চীন মৈত্রী সীমাহীন এবং চিরকালীন। কিন্তু এবার এমন কোনও কথা শোনা যায়নি তার মুখে।

এদিকে, সাংহাই কোঅপারেশন শীর্ষবৈঠকের ঠিক ১০ দিন আগে মস্কোর ‘মানবিক নীতি’ প্রকাশ করে ভারত এবং চীনের সঙ্গে সখ্য বাড়ানোর কথা বলেছিলেন পুতিন। ইউক্রেন যুদ্ধের সাড়ে ছয় মাসের মাথায় প্রকাশিত ৩১ পাতার ওই নথিতে বলা হয়, রুশ ঐতিহ্য এবং আদর্শের রক্ষা ও শ্রীবৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই এই পদক্ষেপ করতে হবে। কিন্তু সমরখন্দে মোদি ও জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকে পুতিনের সেই পরিকল্পনা অনেকটাই এলোমেলো হয়ে গেল বলে শনিবার থেকে জল্পনা শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্ব। সে কারণেই কি শুক্রবার প্রথম বার সংঘাত বন্ধ করার কথা বললেন পুতিন?