রূপালী চৌধুরী নামটা শুনলেই বার্জার পেইন্টস’র কথা মাথায় আসে। কোম্পানির সবচেয়ে পরিচিত এবং সফল ব্যক্তিও তিনি। টানা ৩৪ বছর যাবৎ কোম্পানির বিভিন্ন পদে কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে বার্জারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে রয়েছেন রূপালী চৌধুরী। তিনিই প্রথম বাংলাদেশি নারী, যিনি কোনো বহুজাতিক কোম্পানির এত বড় পদে নিয়োগ পান।
একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে নিজ দক্ষতায় এখন তিনি শীর্ষস্থানীয় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এমডি।
এছাড়াও ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মতো বড় বড় সংগঠনে নেতৃত্বও দিয়েছেন রূপালী চৌধুরী। বর্তমানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজের। বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির (সিআইপি) স্বীকৃতিও পেয়েছেন তিনি।
কর্মজীবন সফলতার শীর্ষে অবস্থান করা ব্যক্তিটির ছাত্রজীবন রয়েছে কিছুটা ভিন্নতা। বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করা রূপালী চৌধুরী চেষ্টা করেছেন ডাক্তার হওয়ার। তবে এইচএসসি পাসের পর মেডিকেল কলেজে পরীক্ষা দিয়েও ভর্তির সুযোগ পাননি তিনি। আর মেডিকেল কলেজে চান্স না পাওয়া ও জীবনে পেছনে না তাকানোর মানসিকতাই তাকে শীর্ষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে বলে জানিয়েছেন রূপালী চৌধুরী।
পরে অবশ্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগের রসায়নে স্নাতক করলেও স্নাতকোত্তর আর করেননি। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে (আইবিএ)। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হওয়ায় শুরুতে ব্যবসায় প্রশাসনের অনেক কিছুই ছিল দুর্বোধ্য। তবে পরবর্তী সময়ে সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠেন। এমবিএ সম্পন্ন করে যোগ দেন একটি একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে। এরপর মেধা ও চেষ্টা দিয়ে পার হন একেকটা ধাপ।
এই বিষয়টি নিয়ে রূপালী চৌধুরী দেশের বেসরকারি একটি পত্রিকার সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘মেডিকেলে চান্স না পাওয়াটা পরিবারের জন্য হার্ট ব্রেকিং ছিল। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হলাম। কিন্তু আমার খুব কাছের বন্ধু আব্দুল হকের (বর্তমানে স্বামী) প্রেরণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ করি। আমার ফ্যামিলি থেকে নিরুৎসাহিত করা হয়। তবে তার প্রচেষ্টায় আমি ঢাকা আসি।’
পড়াশোনা শেষ করে সবাই যখন সরকারি চাকরিতে ঢোকার চেষ্টায়, সেই সময়েও রূপালী চৌধুরীর যাত্রা ছিল স্রোতের বিপরীতে। যুক্ত হন করপোরেট প্রতিষ্ঠানে। ১৯৮৪ সালে বহুজাতিক কোম্পানি সিবা গেইগি বাংলাদেশে সাধারণ কর্মী হিসেবে যোগ দেওয়ার মাধ্যম তার কর্মজীবন শুরু হয়। এরপর ১৯৯০ সালে বার্জার পেইন্টস’এ যোগ দেন তিনি।
বার্জারে যোগ দেওয়ার গল্পটাও শুরু হয় ভিন্নভাবে। মূলত, ১৯৮৯ সালে একসময়কার সহপাঠী আব্দুল হকের সাথে বিয়ে হয় রূপালী চৌধুরীর। বিয়ের এক বছর পরেই চট্টগ্রামে বদলি হন আব্দুল হক। তখন রূপালী চৌধুরীও সিদ্ধান্ত নেন চট্টগ্রাম চলে যাওয়ার। এ কারণে সিবা গাইগির চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। ওই সময় চট্টগ্রামে জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয় বার্জার। ওই বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করেন রূপালী চৌধুরী। এরপর কয়েক ধাপের সাক্ষাৎকারে উত্তীর্ণ হয়ে প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে যোগ দেন বার্জারে।
এই প্রসঙ্গ কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি চট্টগ্রামে থাকার জন্য একটি চাকরি খুঁজছিলাম। পত্রিকায় বার্জারের একটি পদে লোক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেখলাম। তারা বেশ কয়েকদফা সাক্ষাৎকার নিলেন। পরিকল্পনা ব্যবস্থাপক পদে একটি মেয়ে কাজ করতে পারবে কি না, এটা নিয়ে তারা দ্বিধায় ছিলেন।’ রূপালী চৌধুরী বলেন, অনেক কষ্টে আমার চাকরিটা হয়। ওই পদে সিঅ্যান্ডএফ প্রতিনিধিদের সাথে কাজ করতে হবে, কাস্টমসের সাথে কাজ করতে হবে, বন্দরে যেতে হবে। ওই সময় একটি মেয়ে এসব কাজ করতে পারবে, সেটা তারা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।
নারীদের নিয়ে বার্জারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ভয়কে জয় করতে সক্ষম হন রূপালী চৌধুরী। বিভিন্ন বিভাগে কাজ করার পর ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত হন তিনি। তিনি বলেন, আমি নারী, এই ভেবে নিজে থেকে কখনো গুটিয়ে যাইনি।
এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি রূপালী চৌধুরীকে। এ প্রতিষ্ঠানেই আছেন ৩৪ বছর ধরে। মার্কেটিং, সেলস, সাপ্লাই চেইন, সিস্টেমসহ বিভিন্ন বিভাগে সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এর মধ্যে ২০০৪ সালে ডিরেক্টর (অপারেশনস) হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০০৮ সালে হন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এখন পর্যন্ত এ পদে তিনবার তার মেয়াদ বাড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
কর্মক্ষেত্রে সফলতার বিষয়ে রূপালী চৌধুরী বলেন, কখনও হতাশ হইনি, হাল ছাড়িনি। সবসময় পরিশ্রম করেছি। সবসময় সব কাজ সময় অনুযায়ী করেছি, কাজ ফেলে রাখিনি। নিজেকে আর পাঁচজন কর্মীর মতো সাধারণ ভেবেছি। ফলে সবাই খুব সহজে গ্রহণ করেছে। এসব কিছুই আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
রূপালী চৌধুরী শুধুমাত্র কোম্পানির কাজে মনোনিবেশ করেছেন এমনটি নয়। তিনি বিভিন্ন সময় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়েও কথা বলেছেন। যেমন- পদ্মা সেতু নির্মাণের পর এর সফলতার বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, এটি দেশের ভাবমূর্তি উন্নত করেছে। আমরা এটা নিয়ে খুব গর্বিত। স্পষ্টতই এই সেতু দেশের দক্ষিণাঞ্চলে স্থানীয় ব্যবসার বিকাশে সহায়তা করবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা যদি কৃষি পণ্যের কথা চিন্তা করি, সেক্ষেত্রেও সেতুটি বাজার বড় করতে সাহায্য করবে। আমরা যদি সব শিল্পের জন্য ইকোসিস্টেমের বিকাশ ঘটাতে পারি, তবে এটি সুফল বয়ে আনবে।’
রূপালী চৌধুরী সফলতার পুরস্কারও পেয়েছেন বেশ কয়েকটি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সরকারের মর্যাদাপূর্ণ ‘সিআইপি’ স্বীকৃতি। সবমিলিয়ে মোট ৯ বার এ স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। সর্বশেষ ২০২৩ সালে এই স্বীকৃতি পান তিনি।
সিআইপি হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে রূপালী চৌধুরী বলেন, শিল্প প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক হিসেবে শিল্পবান্ধব বিভিন্ন আইন-কানুন অনুমোদনের জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার হিসেবে কাজ করতে পারে শিল্প মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধনের ফলে ব্যবসা পরিচালনা আরও সহজ হয়ে উঠতে পারে।
এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জনপ্রিয় সাময়িকীর পাতায় গত বছর ২০২৩ সালে জানুয়ারি সংখ্যায় উঠে আসে রূপালী হক চৌধুর’র কথা। দেশে উন্নতমানের পেইন্টস সল্যুশনের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে বলে এ লেখায় উল্লেখ করেন তিনি। টাইম ম্যাগাজিনে নিজের লেখা দেখতে পেরে আনন্দচিত্তে সেই দিন রূপালী হক চৌধুরী বলেন, ‘টাইম’র মতো স্বনামধন্য একটি সাময়িকীতে আমার ভাবনা তুলে ধরতে পেরে আমি অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করেছি।
তিনি আরও বলেন, বিদেশি বিনিয়োগে স্থাপিত মাল্টিন্যাশনাল শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের জন্যও সিআইপি হিসেবে স্বীকৃতি লাভের সুযোগ থাকা দরকার। এর ফলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে তারা আরও উৎসাহিত হবে।
সফল এই নারী ব্যক্তিত্ব নিজের সফলতার পেছনে মূলত সততা, কাজের প্রতি একাগ্রতা, প্রতিশ্রুতি এবং কঠোর পরিশ্রমকেই প্রধান্য দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘অনেকেই মনে করেন আমি মেধার বলে সর্বোচ্চ পর্যায়ে এসেছি। কিন্তু মেধা বা ট্যালেন্ট শুধু একটা বিষয়। বাকিটা হলো ইনোভেশন, অনেস্টি, ইন্টিগ্রেটি, কমিটমেন্ট অ্যান্ড হার্ড ওয়ার্কিং।’