শুক্রবার (৫ আগস্ট) বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ক্যাপ্টেন ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল এর জন্মবার্ষিকী। বাংলাদেশের আধুনিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি তার তত্ত্বাবধানে সৃষ্টি হয় ‘স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী’। সংগীতের সাথে জড়িত তরুণদের অন্যতম ঠিকুজি হয়ে উঠে এই দলটি।
লোকজ থেকে আধুনিক, সব ধরনের গানের চর্চা হতো এখানে। এমনকি আধুনিক যন্ত্র সংগীত সহযোগে স্বাধীন বাংলাদেশে স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠীর সদস্যরাই প্রথম গান শুরু করেন। এমনকি হাল সময়ের ফিউশনের চর্চাও সেই সময়ে শুরু করে স্পন্দনের শিল্পীরা। বাংলার লোক গানকে একটু অন্য মেজাজে পরিবেশন করে শ্রোতাদের মধ্যে খুব কম সময়ে সাড়াও ফেলতে সক্ষম হন তরুণ শিল্পীরা। আর এসবের পেছনে একজনই ছিলেন, শেখ কামাল।
তার হাত ধরেই প্রতিষ্ঠাকালীন বছরেই স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠীতে যোগ দেন কিংবদন্তী মিউজিশিয়ান ও বর্তমানে শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক কাজী হাবলু। খুব কাছ থেকে দেখেছেন সাংস্কৃতিক জাগরণে নিবেদিত শেখ কামালের ছুটোছুটি। জন্মদিনে সেইসব অভিজ্ঞতার গল্পই বলেছেন চ্যানেল আই অনলাইনকে।
যুদ্ধচলাকালীন আমি খুলনা রেডিওতেও ছিলাম। পরে সেখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেই। সদ্যই দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমি তখন বেকার। কিন্তু সংগীতের প্রতি আমার যে প্রেম, সেটা তখন অনেকেই জানতেন। স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠার বছরের কোনো এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে শেখ কামাল ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম দেখা। নাসির আহমেদ অপু, মনসুর আহমেদ নিপু- এরকম আরও অনেকেই সেই সময়ে কামাল ভাইয়ের খুব কাছের ছিলেন। তাদের কেউ একজন পরিচয় করিয়ে দিলেন। কামাল ভাই আমাকে বললেন, স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠীতে যোগ দিতে। এটা কিন্তু কোনো ব্যান্ড নয়, এটা শিল্পী গোষ্ঠী। সেই সময়ে সংগীতের বিভিন্ন জনরার তরুণরা এখানে যুক্ত হন। কেউ দেশের গান করতো, কেউ ফোক গান করতো। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা এখানে যুক্ত ছিলেন। এখানের একটা অংশ ব্যান্ডের গান করতো।
স্পন্দনে যোগ দিয়ে এবং কামাল ভাইয়ের সাহচর্যে এক নতুন দুনিয়ার সন্ধান পাই। সংস্কৃতির প্রতি তার যে মমতা দেখেছি, একজন প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হয়েও তার যে সাধারণ চলন বলন আমরা স্বচক্ষে দেখেছি- তাতে আমাদের মুগ্ধ না হয়ে উপায় ছিলো না। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সাংস্কৃতিক জাগরণে তারুণ্যকে উজ্জীবিত করতে যা যা প্রয়োজন, সব দায়িত্ব তাকে নিজ কাঁধে তুলে নিতে দেখেছি। সাংস্কৃতিক জাগরণ বলতে তিনি শুধু সংগীত কিংবা থিয়েটারকে বুঝাননি- তিনি ক্রিড়াঙ্গনকে শক্তিশালী করতে সেই সময় নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। থিয়েটার ও সংগীতের পাশাপাশি ক্রীড়াকেও তিনি সাংস্কৃতিক জাগরণের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।
আমাদের গানের দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে, তাই বলে কিন্তু আমরা চাইতেই সব কিছু পেয়ে যাইনি। তিনি চাইতেন, আমরা কষ্ট করে সব অর্জন করি। তিনি বার বার আমাদের উদ্দেশে বলতেন, ‘এখন কষ্ট কর, পরে পোলাউ খাইস’। এই গভীর কথা আমাদের বুঝতে সময় লেগেছে। এই দলে এসে আমি কিংবা আমার মতো অনেকে তার নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন। কিছুই জানতাম না, মিউজিক কীভাবে করে, কীভাবে সুর করে- সব কিছু স্পন্দনে এসে শিখেছি। আমাদের তৈরী করেছেন শেখ কামাল।
সংগীতের গতিপথ কেমন হবে, সেটা নিয়েও তার দুরদর্শী ভাবনা আমরা খুব কাছ থেকে দেখেছি। কামাল ভাই নিজেও গান পছন্দ করতেন। সেতার বাজাতে ভালোবাসতেন। লোকজ গানে আধুনিক যন্ত্রসংগীতের ব্যবহার, তার পরামর্শেই আমরা অ্যাপ্লাই করি। ব্যান্ড কালচার নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। সেই সময়ে অনেকেই ব্যান্ডে গানের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। কিন্তু আমরা দমে না গিয়ে চর্চা অব্যাহত রেখেছি। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীত নিয়ে কথা হলে স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠীর অবদান এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
শুধু সংগীত অঙ্গন নয়, কামাল ভাই যেখানেই স্পর্শ করেছেন- সেখানেই মানুষকে আলোড়িত করেছেন। তার এই গুণ আমরা খুব কাছ থেকে দেখেছি। আমি সংগীতের মানুষ ছিলাম, তাই সংগীতে তার প্রভাব নিয়ে বলতে পারছি। নিজে আলোড়িত হয়েছি, উজ্জীবিত হয়েছি। আমি নিশ্চিত ক্রিড়া কিংবা নাট্যাঙ্গনে কামাল ভাইকে যারা পেয়েছেন- তারা হয়তো আমাদের চেয়ে আরও বেশি আলোড়িত হয়েছেন।