
মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে চোখে পড়েছে লেখক পাঠকদের এক মধুর মিলনমেলা। স্টলের সামনে বেশ ভিড়ও লক্ষ্য করা গিয়েছে। প্রিয় লেখকের সাথে ক্যামেরাবন্দি হচ্ছেন অনেকে। তবে প্রকাশকদের হতাশার চিত্র যেন মেলা প্রাঙ্গণেরই চিত্র। দর্শনার্থীদের স্টলে স্টলে ঘুরতে দেখলেও বই হাতে পাঠকদের সংখ্যা খুবই কম।
এরই মাঝে শেষ হয়েছে অর্ধেকের বেশি সময়। বইমেলা ভিড় জমাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। বেশ আনন্দের সাথে ঘুরছেন প্রতিটি বইয়ের স্টল। যাচাই করে নিচ্ছেন প্রিয় বই। দিন শেষে মেলা থেকে সুন্দর স্মৃতি, আনন্দ আর খালি হাতে ফিরছেন বাসায়। প্রকাশকরা বলছেন: মেলায় পাঠকের উপচে পড়া ভিড়, কিন্তু বই বিক্রি আশানুরুপ নয়।
সময়ের হিসেবে বৃহস্পতিবার গেট খোলার কথা বিকেল ৩টায়। মেলা প্রাঙ্গণে দেখা যায় দুপুরের পর থেকে মানুষের ভিড়। নির্ধারিত সময়ের ১ ঘণ্টা আগে বেলা ২টার দিকে পুলিশের সারি সারি গাড়ি এসে থামছে বাংলা একাডেমির গেটে। পুলিশ সদস্যরা গাড়ি থেকে নেমে নিরাপত্তার কাজে লেগৈ যান। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে মানুষের ভিড়।
মেলা শুরুর আগে যেমনটা পরিকল্পনা ছিল মেলার অর্ধেক সময় অতিবাহিত হলেও আশানুরুপ ফল নেই উল্লেখ করে অন্য প্রকাশের স্টল ইনচার্জ তৌহিদুল ইসলাম বলেন: মেলা শুরুর আগে আমরা আশাবাদী ছিলাম, করোনা মহামারীর পর এই বছর নির্ধারিত সময়ে মেলা শুরু হয়েছে। যার ফলে আমাদের প্রত্যাশাটাও একটু বেশিই ছিল। কিন্তু মেলা শুরুর পর থেকে ১৬তম দিনে এসেও আমাদের হতাশ করছে। আগের যেকোন সময়ের চেয়ে এবার বই বিক্রি অনেক কম হচ্ছে। মেলায় ভিড় জমাচ্ছেন আনেকে কিন্তু বই কিনছেন না। ঘুরছেন লেখকদের সাথে ছবি তুলছেন, দিন শেষে শূন্য হাতে বাসায় ফিরছেন।

ছুটির দিনগুলোতে প্রত্যাশার আলোকে বই বিক্রি নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৪ ফেব্রুয়ারিসহ অন্যান্য ছুটির দিনগুলোতেও বইপ্রেমী পাঠকদের ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এবারের মেলা আমাদের হতাশ করছে। তবে আগামীর দিনগুলোতে ভালো বই বিক্রি হবে বলেও আশা রাখছেন তিনি। তার মতে, এখনো হুমায়ুন আহমদের বই পাঠক পছন্দের শীর্ষে। তবে নবীনদের মধ্যে সাদাত হোসাইনের বইও গত কয়েক বছরের ন্যায় এই বছরও পাঠকের আগ্রহের তালিকায় রয়েছে।
অনন্যা প্রকাশনার স্টল ইনচার্জ মিজানুর রহমান বলেন: এখন পর্যন্ত মেলা আমাদের হতাশ করছে। তবে সামনের দিনগুলোর জন্য আমরা আশা রাখতে পারি। ২১ ফেব্রুয়ারির দিকে আমাদের মূল ফোকাস থাকবে। ভালো সময়ের অপেক্ষায়।
গ্রন্থমেলার শেষ সময় এসেও প্রকাশকরা বাণিজ্যিকভাবে অনেকটা পিছিয়ে আছে উল্লেখ করে সময় প্রকাশনীর প্রকাশক ফরিদ আহমেদ বলেন: গত দু’বছর করোনার কারণে আমরা সকল দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। সে হিসেবে চলতি বছরের মেলা নিয়ে প্রকাশকরা বেশ আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু মেলার শেষ সময়ে এসে বলতে হচ্ছে ২০২০ সালের মেলার তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে এবারের বাণিজ্য। তবে তিনি আশা করছেন মেলার শেষ সপ্তাহে পরিবর্তন হতে পারে এই চিত্র। পাঠক আসবেন এবং ভালো বইগুলো সংগ্রহ করবেন। আর প্রকাশকরাও নিজেদের খারাপ অবস্থা কাটিয়ে উঠবেন বলে মনে করছেন তিনি।
কেন মেলায় বই বিক্রি কম
কুমিল্লা থেকে মেলায় আসছেন মধ্যবয়সী মো. আবদুল হক। তিন-চারটি স্টল ঘুরে একটি বইও কিনেছেন। কথা বললে জানান হতাশার কথা। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন তুলনামূলক কম দামে বই কিনবেন বলে। কিন্তু বইয়ের মূল্য অনেক বেশি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে এসেছি কয়েকটি বই কিনবো বলে। কিছু বই পছন্দও হয়েছে। কিন্তু দামটা আমাকে হতাশ করেছে। এত টাকা দিয়ে বই কেনার মতো সুযোগ আমার নেই। তারপরও আরো কিছু বই দেখবো। তার মতো বইয়ের দাম নিয়ে হতাশ হচ্ছেন অনেক পাঠকই।
বিক্রয়কর্মীরা বলছেন, পাঠকের সমাগম কিছুটা থাকলেও বিক্রি হচ্ছে না। তারা স্টলে আসতেছেন, বই খুলে দেখছেন, মূল্য জিজ্ঞেস করছেন। তারপর না কিনে ফিরে যাচ্ছেন। মনে হচ্ছে বইয়ের মূল্য কিছুটা প্রভাব ফেলেছে। তবে সত্যিকারের বইপ্রেমীরা ঠিকই বই কিনে নিচ্ছেন।
স্টল ইনচার্জ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, প্রকাশকরা সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বইয়ের প্রতিটি উপকরণের মূল্য দ্বি-গুণ থেকে তিন গুণ বেড়েছে। সে হিসেবে বইয়েল মূল্য বৃদ্ধি করা হয়নি। সামান্য পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে, যা না করলে নই। তবুও পাঠকরা বলছেন, বইয়ের দাম বেশি।
গ্রন্থমেলা পাঠক সমাজের প্রাণের মেলা, তারা মেলা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না। শেষ সাপ্তাহে আরও বেশী পাঠক সমাগম হবে বলে উল্লেখ করে বাংলা একাডেমির প্রশাসন, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক এবং অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৩-এর সদস্য সচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বলেন: মেলায় ভিড় হচ্ছে। করোনার পরবর্তী সময় হিসেবে সমাগম বাড়ছে। মেলার কাঠামো, গত যেকোন সময়ের চেয়ে বেশ সুন্দর এবং সুশৃঙ্খল হয়েছে বলে তিনি জানান।
মূল্য বৃদ্ধি কিছুটা প্রভাব পড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বইয়ের মূল্য বৃদ্ধি বই বিক্রির ক্ষেত্রে প্রভাব পড়েছে। যার ফলে প্রকাশকরা ঘাটতিতে রয়েছে। তার মতে, পাঠকের বাজেট আগের ন্যায় রয়েছে, তারা মেলায় এসে দেখছেন বইয়ের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও আনুষাঙ্গিক খরচও বর্তমান সময়ে বেশ চওড়া। যার ফলে, অনেকেই মেলায় এসেও বই না কিনে ফিরে খালি হাতে ফিরে যেতে হচ্ছে।
গ্রন্থমেলার সদস্য সচিব, লেখক এবং বিক্রয়কর্মীসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই প্রত্যাশা করছেন, মেলার শেষ সপ্তাহে এসে এই চিত্রের পরিবর্তন ঘটবে। পাঠকরা তাদের পছন্দের বই কিনবেন। প্রকাশকরা তাদের বাণিজ্যিক সাফল্য পাবেন। ভালো বইয়ের বিক্রি বাড়বে-এই আশাবাদ ব্যক্ত করছেন প্রকাশক ও সংশ্লিষ্টরা।