খবরটা এসেছিল ছোট ছেলে শিবনাথ কাহারের ফোনে! ফোনের ওপাড়ের মানুষটি হিন্দিতে বলছিল আপনার বাবা রতন কাহার এবার পদ্মশ্রী পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন। ফোনে শোনার পর বিশ্বাসই করতে পারেনি শিবনাথ। সে তাড়াতাড়ি বাড়িতে এসে বলে বাবা রতন কাহারকে, সে কথা। তখন সিউড়ির বাড়িতে ছোট বোন শ্রাবণী, মেঝভাই প্রভাত আর মা শান্তিও বাড়িতেই ছিল! তারাও খবরটা শোনার পর থেকেই, সবাই অবাক! এই বয়সে এসে ভাদু গাইয়ের এমন সম্মান, বিশ্বাস করতে অসুবিধা হচ্ছিল অশীতিপর বৃদ্ধা রতন কাহারের! দীনদুঃখী মানুষের এমন সৌভাগ্য হবে, মানতে মন চায় না। কিন্তু খবর সত্যিই, বলে উঠে রতন কাহারের সিক্স পাশ করা কণ্যা শ্রাবণী কাহার। ততক্ষণে খবরটি ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত সামাজিক মাধ্যমে। সিউড়ির সংবাদপত্রের পাশাপাশি, টিভির চ্যানেলের সাংবাদিকরাও এসে হাজির।
রতনের এবার বিশ্বাস হয়, শিবনাথের কথাটা।
এবছর তাঁকে ভারত সরকার পদ্মশ্রী পুরস্কার দিচ্ছে ভাদু আর লোকগানের অবদানের জন্য। রতন কাহারকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, আমার জন্ম ১৯৩৫ সালে। তবে তাঁর মেঝ ছেলে শিবনাথ কাহার রতন কাহারের ভোটার কার্ড দেখিয়ে বলেন, এই দেখুন ১৯৪৫ লেখা কার্ডের তথ্যে বাবার বয়স। তখন বৃদ্ধ রতন কাহারের পাশেই বসে ছিল তাঁর স্ত্রী শান্তি। তিনি মৃদু স্বরে বলেন, বহুদিনত গান লিখছে বাবা। কেউ তেমন সম্মান করেনি। এতদিনে আমাদের দেশের সরকার মুখ তুলে তাকিয়েছে। খুব আনন্দ হল শেষজীবনে। এবার মেয়েটার একটা গতি করতে পারলেই বাঁচি। একই আক্ষেপ ছোট ভাই শিবনাথের গলাতেও। সেও বলে বোনের জন্য তেমন পছন্দের পাত্র পাচ্ছি না। এই নিয়েই বাবার চিন্তা। তবে বাবা এর মধ্যেও দাঁড়িয়ে গান বাঁধেন। সুর দেন। রতন কাহার বলেন, এখন আমার কাছে ৩০০ মতো গান লেখা আছে খাতায়। ১৯৭৬-৭৭ সালে আমাদের বীরভূমের সিউড়ি এলাকায় ঝড় হয়েছিল খুব বড়। সেই ঝড়ে একটি বট গাছ পরে ভেঙ্গে গিয়েছিল ঘর। ঝড়বৃষ্টিতে কয়েকটি গানের খাতা গিয়ে ছিল ভেসে! আরও বহু গান গেছে হারিয়ে। লোকসুরের পথিক রতন কাহারের ছোট ছেলে শিবনাথ কাহারের কাছে, গত বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টাতে ফোন আসে, দিল্লির কেন্দ্রীয় পদ্মশ্রী কমিটির দপ্তর থেকে। সেই শুরু হয় রতন কাহারের ঘরে লোকজনের আনাগোনা। ঘরে তেমন বসতে, দাঁড়াতে দেওয়ার জায়গাও নেই। তবুও একমুখ হাসি নিয়ে বাবার সম্মানের কথা ভেবে সিক্স ক্লাস পর্যন্ত পড়াশোনা করা মেয়ে শ্রাবণীও চা করে আনে অতিথিপূজার জন্য। আর তার সঙ্গী হয় ছোট দাদা শিবনাথ। যদিও রতন কাহারের বড় ছেলে নাড়ুগোপাল কাহার দুর্গাপুরে থাকে, কোম্পানির কারখানাতে শ্রমিকের কাজ করে। আর রতনের মেঝ ছেলে প্রভাত কাহার লটারির টিকিট বিক্রি করে, সিউড়ি শহরের কোর্ট বাজারে। আর রতন কাহারের আদরের ছোট ছেলে শিবনাথ থাকে মাছের আড়তে। সে আরও বলে, এই সময় প্রচুর লোক আসছে বাবাকে দেখতে। বাবার পাশাপাশি আমরাও গর্বিত এমন পুরস্কার ঘোষণায়।
জীবন সায়াহ্নে এসে পদ্ম সম্মান পেলেন বীরভূমের লোক সংগীতশিল্পী রতন কাহার। রতন কাহারকে পদ্মশ্রী সম্মানের জন্য বেছে নেওয়ার কথা ছড়িয়ে পড়তেই বীরভূমের পাশাপাশি সিউড়ির বাসিন্দাদের মধ্যেও আনন্দের সীমা নেই। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সর্বত্র তাঁর নামের জয়-জয়কার। সকলেই রতনের সঙ্গে তোলা ছবি পোস্ট করে, ভরিয়ে তুলছে ফেসবুকের ওয়াল।
এ যেন মেঘ না চাইতেই জল পাওয়া। জীবনে অনেক কিছুই চেয়েছিলেন রতন কাহার। তবে সবটা আর পাওয়া হয়ে ওঠেনি। অবশেষে না চেয়ে পাওয়ার মতোই অতর্কিতে গত বৃহস্পতিবার বিকেলের একটি ফোন যেন নতুন করে বদলে দেয় তাঁর জীবন।
ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মশ্রীতে ভূষিত হতে চলেছেন লোকগানের সম্রাট রতন কাহার। ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের এক দিন আগে বৃহস্পতিবার ‘পদ্ম পুরস্কার ২০২৪’ ঘোষণা করা হয়। একসময় তাঁর লেখা ‘বড়লোকের বিটি লো’ অনেকেই গেয়েছেন দুই বাংলার শিল্পীরা। মাঝে খানে বিতর্কও হয়েছিল তাঁর এই কালজয়ী গানকে কেন্দ্র করে। বলিউড র্যাপার বাদশা তাঁর এই গান অন্য মোড়কে তৈরি করলেও, কোথাও নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেননি শিল্পী। পরে নিজের সোশ্যাল মিডিয়ায় রতন কাহারের কাছে ক্ষমা চেয়ে তাঁকে সাম্মানিক হিসেবে পাঁচ লাখ টাকা পাঠিয়েছিলেন। সেই শুরু আলোচনা। এবার সেই রতন কাহারই পেতে চলেছেন পদ্মশ্রী পুরস্কার। তাঁর গান এখন বহুমানুষের কণ্ঠে বাজে। তবে সিউড়ির গায়িকা কাকলি দাস, রতনের গানে এখন বেশ জনপ্রিয়।
রতনের পুরস্কার প্রাপ্তির খবরে, অনেকেই বলছেন অবশেষে তিনি জীবনের সন্ধিক্ষণে এসে যোগ্য সম্মানটুকু পেলেন। বয়স শেষে রতন কাহারকে পদ্মশ্রী সম্মান দেওয়ার জন্য নির্বাচিত করার পর রতন কাহার বলেন, “আমি খুবই আনন্দিত, আমি খুবই গর্বিত। আমার দেশের সরকারকে শ্রদ্ধা জানাই। তাঁরা আমার মতো মানুষকে বেছেছেন এতে আমি খুবই গর্বিত। ” এর পাশাপাশি এমন সম্মান পাওয়ার আগে তিনি যে সাধারণ কিছু মানুষ ছাড়া সেই ভাবে কারো কাছে সম্মান পাননি সেই বিষয়টিও ক্ষোভের সঙ্গে বলেন। রতন কাহারের জীবনে পদ্মশ্রী সম্মান নতুন এক অধ্যায় তৈরি করল। প্রান্তিক জীবনের এই মানুষটি তাঁর সৃষ্টিতেই আলোয় ফিরেছেন।
রতন কাহার একজন ভাদু, টুসু, আলকাব, ঝুমুরের মতো গান নিয়ে সংগীত রচনা এবং পরিবেশন করেন। নেচে নেচে গান নিজের লেখা ঝুমুর। তবে তার জীবনে সবচেয়ে বড় আলোচনার গানটি হল ‘বড়লোকের বিটি লো’।
কেন্দ্রের তরফে এই সম্মান পেয়ে বর্ষীয়ান এই সংগীতশিল্পী আরও বলেন, “অনেকদিনই গান-বাজনার জগতের সঙ্গে রয়েছি। বহু অভাব-অনটনে কেটেছে। তবে গান চালিয়ে গিয়েছি। গান না গাইলে আমি বাঁচতে পারতাম না। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে পদ্মশ্রী সম্মান দেওয়া হচ্ছে আমাকে। আমি আজ দারুণ খুশি হয়েছি। বড়লোকের বিটি লো গানটা ১৯৭২ সালে লিখেছিলাম। ১৯৭৬ সালে স্বপ্না চক্রবর্তী গানটি রেকর্ড করেছিলেন। তবে আমার উপর অবিচার হয়েছিল খুব। সুরকার-গীতিকার হিসেবে আমার নাম উল্লেখ করেননি কেউ। বহুমানুষ প্রতিবাদ করেছিলেন। পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন আমার।”
বর্তমানে চরম আর্থিক দুর্দশায় রয়েছেন রতন কাহার। কিছুদিন আগে একাধিক সংবাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল তাঁর দুর্দশার কথা। সঞ্চয় করা টাকা থেকে পাওয়া সামান্য সুদ আর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লোকশিল্পী ভাতায় কোনো রকমে সংসার চলে তাঁর। কেউ খোঁজও রাখে না আর এই গুণী শিল্পীর! তবে বিতর্কই যে তাঁকে নতুন করে সামনে এনেছিল, এটা সত্যি। তিনিও মানেন সে কথা। ২০২৪ সালের মার্চ-এপ্রিলে রাষ্ট্রপতি ভবনে ভারতের রাষ্ট্রপতি পদ্ম সম্মানের ঘোষিতদের হাতে পদক তুলে দেবেন। তখনকার জন্য অপেক্ষা রতনের!
অবশেষে শেষজীবনে হলেও রতন কাহারের ভাগ্যে সম্মান জুটলেও, এই বীরভূমের কালজয়ী আরও দুই গীতিকার হারহিম গেছেন অসম্মানের মৃত্যু কবলে! বীরভূমের কেন্দুলীর গীতিকার দাস রাধাময়, হেতমপুরের আশানন্দনের ভাগ্য ফেরেনি জীবিত কালে! আজও আক্ষেপ করে বীরভূম বাসী!