ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে উচ্চ মাধ্যমিকের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখে শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে শুরু হয় অন্য এক নতুন যুদ্ধ। যার জন্য শিক্ষার্থীরা মোটেই প্রস্তুত থাকে না। প্রস্তুত থাকার কথাও না। র্যাগিং কিংবা ছাত্র রাজনীতির নামে চলে নবীন শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন। সংবাদের শিরোনাম হয় মেধাবী শিক্ষার্থীরা, না সেটা ভালো কিছু অর্জনের জন্য নয়। শিরোনাম হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক পুরনো শিক্ষার্থীদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে।
বাস্তব জীবনে এক প্রতিবাদী চরিত্রের নাম পরীমনি। দেশের চলচিত্র প্রাঙ্গণে বেশ দাপটের সাথে কাজ করছেন এই নায়িকা। সিনেমার পাশাপাশি তার সাথে ঘটে যাওয়া যেকোন ধরনের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে একটুও পিছপা হয়নি ঢাকাইয়া সিনেমার এই আলোচিত নায়িকা। বরাবরই আলোচনায় থাকা এই নায়িকাকে যেতে হয়েছে কারাগারেও। তবে সকল কিছু থেকে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করেন। নিজের সাথে ঘটা সকল অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন নিজেই। তার মতোই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়ে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ফুলপরী।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিছু দিন পর পর শিরোনাম হচ্ছে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন নিয়ে। সর্বশেষ সামনে আসে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা। ঐ ছাত্রী প্রতিবাদী হওয়ায় নতুন করে আলোচনায় এসেছে বিষয়টি। অথচ হাজারো শিক্ষার্থী নিরবে সহ্য করছে নির্যাতন। অনেক শিক্ষার্থীর বাধ্য হচ্ছে হল ছাড়তে। অনেকে আবার ছেড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ও।
তেমনি এক নির্যাতিত শিক্ষার্থীর নাম ফুলপরী। তবে অন্য শিক্ষার্থীর ন্যায় সহ্য করার মানসিকতা নয় তার। হয়ে উঠেছেন প্রতিবাদী। নিজের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে নেমেছেন নিজেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাস্তব চিত্র চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন নিজেই। তিনি বলেন, ‘আমার সাথে যে অন্যায় হয়েছে তা যেন আর কোন শিক্ষার্থীর সাথে না ঘটে, তার জন্য আমার এই আওয়াজ। যারা এসবের সাথে জড়িত, তাদের সকলকে সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তবেই অন্য শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করার সাহস পাবে।’
সম্প্রতি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের এই নবীন ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে রাতভর র্যাগিং ও নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তার কয়েকজন সহযোগীর বিরুদ্ধে। চলছে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত। তদন্তের স্বার্থে কথা বলতে রাজি নন, তদন্ত কর্মকর্তারা। নির্যাতিত শিক্ষার্থী হল ছেড়ে অবস্থান করছে নিজ বাসায়। নির্যাতনের পর প্রতিবাদ করায় শিক্ষার্থীর পাশে দাড়িয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীসহ সারাদেশের মানুষ। প্রতিবাদ জানাচ্ছেন নিজেদের অবস্থান থেকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে র্যাগিংয়ের কারণে লেখা-পড়ার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এটা এখন দাম্ভিকতায় পরিণত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মনে আমিত্ব ভাব বহন করছে। জাতীয় রাজনীতির একটা বড় প্রভাব পড়েছে ছাত্র রাজনীতিতে। যার ফলে দূষিত হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা।
নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় তৃণমূলে কাজ করে যাচ্ছেন মানবাধিকার কর্মী খুশি কবির। তিনি বলেন: আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ একদিনে নষ্ট হয়নি, এটা নষ্ট হয়েছে ধীরে ধীরে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা আজ নিরাপদ নয়। ক্ষমতাসীন দল তাদের ছাত্ররাজনীতিকে প্রভাবিত করতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। করছেও তাই। যার ফলে, শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় তাদের নিয়মিত কার্যক্রমে অংশ নিতে। এক্ষেত্রে টার্গেট করা হয়, তুলনামূলক নবীন শিক্ষার্থীদের। যার ফলে, শিক্ষার্থীদের মাঝে একটা আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে। তারা দূরে সরে যাচ্ছে, তাদের লক্ষ্য থেকে।
এর জন্য প্রথমত তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দায়ী করছেন। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই তার দায় নিতে হবে। তারা শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের সঠিক শিক্ষা দিতেও তারা ব্যর্থ হচ্ছে। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আলাদা কমিটি গঠন করতে হবে। যারা শুধুমাত্র, শিক্ষার্থীদের সাথে কাজ করবে। তাদের হলের সমস্যা থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত সমস্যার দিকেও খেয়াল রাখবে। সমাধানের চেষ্টা করবে, সকল ধরনের প্রতিবন্ধকতা।
রাজনৈতিক দলগুলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এক বিশেষ নির্দেশনা জারি করার জন্য আহ্বান জানান খুশি কবীর। তিনি বলেন, শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে এক বিশেষ নির্দেশনা জারি করতে হবে। একটি নিয়ম-নীতির মাধ্যমে তাদের পরিচালনা করতে হবে। তবেই শিক্ষাব্যাবস্থায় পরিবর্তন ঘটবে।
এ বিষয়ে চ্যানেল আই এর সাথে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। তিনি বলেন: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন অস্থিরতা কিংবা এমন অপরাজনীতির মূল কারণ হিসেবে আমি দেখি জাতীয় রাজনীতিকে। কারণ ছাত্র রাজনীতি মূলত লেজুরভিত্তিক রাজনীতি করে থাকে। যার ফলে, নিজেদের মধ্যে একটা দাম্ভিকতা কাজ করে। যেকোন মূল্যে নিজেকে বড় করতে হবে এটাই তাদের উদ্দেশ্য হয়ে পড়ে।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক সাংস্কৃতি নষ্ট হয়ে গেছে। বিচার কিংবা শাস্তির এটাকে এখন সমাধান করা যাবে না। একটা দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার প্রয়োজন। কারণ এটা সাংস্কৃতিক সমস্যা। দীর্ঘদিন পরিচর্চা করার ফলে এমনটা হয়েছে। এখন শাস্তি দিয়ে এটাকে সমাধান করা সম্ভব না। এটাকে কালচারালভাবেই সমাধান করতে হবে। ধীরে ধীরে পরিবর্তন করতে হবে।
কিছু দিন পর পর নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান সংবাদের শিরোনাম হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। তাদের মধ্যে আমিত্বভাব ঢুকে গেছে। সেখান থেকে বের করতে হবে। তবেই আমরা এর সমাধানে আসতে পারবো। আজকে ইবির শিক্ষার্থীকে শাস্তির আওতায় নেওয়ার মাধ্যমে কার্যক্রম বন্ধ রাখলে অন্য কোনো দিন অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় শিরোনাম হবে। যার ফলে আমি মনে করি, একটি বৃহৎ পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে।
শিক্ষার্থীরা নিজেদের লক্ষ্য থেকে সরে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে গবেষণা কিংবা জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিকে দাবিত হওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আজকে তারা ছাত্ররাজনীতি এবং র্যাগিংয়ের কারণে এসব থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। প্রথম বর্ষে একজন শিক্ষার্থী যখন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তখন সে মনে মনে ঠিক করে নেয় দ্বিতীয় বর্ষে গিয়ে নবীনদের এভাবেই নির্যাতন করবে। এই থেকে শিক্ষার্থীকে বের হয়ে আসতে হবে, অন্যথায় শিক্ষাব্যাবস্থায় সফলতার মুখ দেখবে না।
এছাড়াও অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের নিরবতা ভাঙতে হবে। তাদের প্রতিবাদ করতে হবে। অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া থেকে নিজেকে সরে রাখতে হবে। বিচার না হওয়া পর্য্ন্ত তার সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে নির্যাতনের শিকার তুমি একা নয়, অনেকেই হচ্ছে। তবে প্রতিবাদ করার সাহস কিংবা সুযোগ পাচ্ছে না। তুমি প্রতিবাদ করো, তোমাকে সমর্থন করবে হাজারো শিক্ষার্থী। তবেই একটা সময় বন্ধ হবে এমন অপসংস্কৃতি।
তিনি সংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান। বিশ্ববিদ্যায়গুলোতে সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাড়াতে হবে। নাটক, গান কিংবা অভিনয়ের মাধ্যমে এসবের ভয়াবহতা তুলে ধরতে হবে। তবে শিক্ষাব্যাবস্থায় এই ব্যাধি থেকে মুক্তি পাবে।