আমাদের ঘরে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন নুরু কাকার হাত ধরে! তিনিই রবীন্দ্রসঙ্গীতের সাথে পরিচয় ঘটিয়েছিলেন আমাদের। এমনটি সম্ভবত, ময়মনসিংহ শহরের অনেক পরিবারেই।
আমার বাবা স্নেহাশীষ চৌধুরী ছিলেন সাংস্কৃতিক সংগঠক-তবলাবাদক। মা নজরুলসঙ্গীত ও লোকসঙ্গীতের কণ্ঠশিল্পী। দিদি আধুনিক গাইতেন। বোন জামাই লোকগীতি। মোটকথা গান-বাজনার ঘর। সে ঘরে যুক্ত হলেন রবীন্দ্রনাথ!
আশির দশকে ড. আ বা ম নুরুল আনোয়ারের পরিচয়সূত্রে আসলেন, সঙ্গীত গুরু ওয়াহিদুল হক, আচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদার। এইভাবে আমাদের রবীন্দ্র পরিচয়। শুরুটা আমার জন্মকাল থেকে, পঞ্চান্ন বছরের বেশি!
নুরু কাকার সন্ধান গোষ্ঠী, কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাব, শিশুতীর্থ, আনন্দধ্বনি, জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ সবখানেই একসাথে ছিলাম। ১৯৮৮ সালের দিকে আমার সম্পাদনায় প্রকাশ করিয়েছেন, ‘সঙ্গীত-সংকলন’। সেই প্রকাশনায় থাকতো পঞ্চকবির গান, গান বিষয়ক লেখালেখি। তিনি আমাকে যুক্ত রেখেছেন গানে-সাংগঠনিক কাজে। নুরু কাকা প্রায়ই বলতেন, আমাদের ছেলে কন্ঠের বড় অভাব, গানটা করিস! কিন্তু জীবনতো শুধু গান নয়, জীবিকার তাগিদে বেরিয়ে গেলাম প্রাণের শহর ময়মনসিংহ থেকে, গানকে দিলাম ছুটি!
চট্টগ্রামে শীলা কাকীমা (শীলা মোমেন) কিছুটা চেষ্টা করলেন গানটা করানোর, আমি পারিনি। ঢাকায় দীর্ঘ সময় ওয়াহিদ কাকা, নীলোৎপল স্যার, বুলবুল ভাই, মিতা আপা সকলকে ঘিরে থেকে সংগঠন করা হলেও গানটা হয়নি। না হোক, গানের ভেতরেই তো ডুবেই থাকি সারাক্ষণ। গানের সবটাই সঙ্গীতগুরু নুরু কাকার অবদান।
নুরু কাকা আজ (বুধবার) আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন!
তার পরিচয় কি শুধু রবীন্দ্রনাথে? না, তিনি কৃষি সম্প্রসারণের প্রফেসর, দেশ-বিদেশের ক্রিকেট ইতিহাস ও ঐতিহ্যের চলন্ত অভিধান, ক্রিকেট খেলোয়াড়-সংগঠক, ইন্ডিয়ান ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক কি তার অজানা?
স্বাধীনতা পূর্বকালে নিষিদ্ধ ঘোষিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মোৎসব, নজরুল জয়ন্তী আয়োজন করে তার প্রতিষ্ঠিত ময়মনসিংহের ‘সন্ধান গোষ্ঠী’। বর্তমান ময়মনসিংহ সার্কিট হাউজের পাশে চার্চের মাঠে আমতলায় আয়োজনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন নুরুল আনোয়ার। দেশপ্রেমে মত্ত এক নীরব মানুষের জীবনাবসান হলো, তার দেশজুড়ে রয়েছে ছাত্র-ছাত্রী, তারা বহন করবে তার উত্তরাধিকার।
নুরু কাকার তিন মেয়ে, কিন্নরী, অমিয়া, প্রমা। ওরাও বাবার গান, জ্ঞানের সাথেই আছে দেশে-বিদেশে। মনে পড়ছে, নজরুলের একটি গান কাকা গুনগুন করতেন, ‘বনের পাখিরে কে চিনে রাখে, গান হলে অবসান, ভালবাসো মোর গান’ – আমরা যেন তাই পারি।
আপনার মহাপ্রয়াণে আমাদের সশ্রদ্ধ অভিবাদন।