জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) যুগ্ম কর কমিশনার মাসুমা খাতুনকে অপহরণের জন্য ৭০ হাজার টাকায় চাকরিচ্যুত গাড়ি চালককে ঠিক করেছিলেন ভুক্তভোগীর সাবেক স্বামী অবসরপ্রাপ্ত অ্যাডমিন ক্যাডার হারুন অর রশিদ।
অপহরণের পর মাসুমা খাতুনকে হাতিরঝিল থানা এলাকার একটি বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল অপহরণকারীদের। জায়গা মতো পৌঁছে দেওয়া হলে অপহরণের মূল হোতা মাসুম ওরফে মাসুদকে (৪২) বিপুল পরিমাণ অর্থ দেওয়ারও আশ্বাস দিয়েছিলেন সাবেক স্বামী হারুন। গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবকে এসব তথ্য জানিয়েছেন মাসুদ ও তার সহযোগীরা।
শনিবার (২৬ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
গত ১৭ আগস্ট রাজধানীর মগবাজার এলাকা থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এ নারী কর্মকর্তাকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা। ১৮ ঘণ্টা পর গত ১৮ আগস্ট রাজধানীর মাদারটেক এলাকা থেকে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে এবং তিন অপহরণকারীকে পুলিশে সোপর্দ করে এলাকাবাসী।
এ ঘটনায় গত ১৯ আগস্ট ভুক্তভোগী বাদী হয়ে তার সাবেক গাড়িচালক ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে রাজধানীর রমনা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা করেন।
এরপর শুক্রবার (২৫ আগস্ট) রাতে গাজীপুরের শ্রীপুর ও রাজধানীর সবুজবাগ এলাকায় অভিযান চালিয়ে মামলার প্রধান আসামি মাসুদ এবং তার সহযোগী মো. আব্দুল জলিল ওরফে পনু (৪৮) ও মো. হাফিজ ওরফে শাহীনকে (৪৮) গ্রেপ্তার করে র্যাব। র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা, র্যাব-১ ও র্যাব-৩ এর যৌথ অভিযানে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
যুগ্ম কমিশনারের ব্যক্তিগত গাড়ি চালক ছিলেন গ্রেপ্তার মাসুদ
খন্দকার আল মঈন বলেন, আসামিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেপ্তার মাসুদ আগে ভুক্তভোগীর ব্যক্তিগত গাড়িরচালক ছিলেন। গত ১ আগস্ট শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে মাসুমা খাতুন তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেন। এতে মাসুমার প্রতি মাসুদের ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার মাসুদ জানায়, প্রতিশোধ নিতে ভুক্তভোগী মাসুমার প্রথম স্বামী হারুন অর রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন মাসুদ। এনবিআর এর ওই নারী কর্মকর্তাকে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকার একটি বাসায় তুলে নিয়ে যেতে মাসুদকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখান হারুন।
মাসুদ আরও জানায়, পরিকল্পনা অনুযায়ী তাকে অগ্রীম ৭০ হাজার টাকা দেন হারুন। এরপর গত ১৫ আগস্ট রাজধানীর সবুজবাগ এলাকায় মাসুদ তার সহযোগী হাফিজ, পনু, রাজু, সাব্বির, সাইফুল ও শান্তকে পরিকল্পনার কথা জানায় ও সবাইকে ৭০ হাজার টাকা ভাগ করে দেয়। তারা রাজধানীর বেইলি রোড এলাকা থেকে ভুক্তভোগীকে অপহরণের সিদ্ধান্ত নেয়। এনবিআরের ওই কর্মকর্তার বর্তমান গাড়িচালকের সঙ্গে গ্রেপ্তার হাফিজের সুসম্পর্ক থাকায় ভুক্তভোগীর অবস্থান মাসুদকে জানায় হাফিজ।
যেভাবে অপহরণ
র্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ১৭ আগস্ট রাত ৮টায় অপহরণকারীরা বেইলি রোড এলাকায় অবস্থান নেয়। রাত ৮টা ১৫ মিনিটে এনবিআর কর্মকর্তা মাসুমা খাতুন মগবাজার থেকে গাড়িযোগে বেইলি রোড এলাকায় পৌঁছলে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী একটি মোটরসাইকেল ও একটি রিকশা দিয়ে মাসুমার গাড়ির গতিরোধ করে অপহরণ চক্রটি। সেসময় মাসুমার গাড়িচালক মোটরসাইকেল ও রিকশা সরাতে গাড়ি থেকে নামলে তাকে মারধর করে। পরে গ্রেপ্তার মাসুদ ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। সেসময় গ্রেপ্তার পনুসহ অন্য সহযোগীরা গাড়িতে উঠে মাসুমাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে হাতিরঝিলের উদ্দেশে নিয়ে যায় এবং বিষয়টি মাসুমার প্রথম স্বামী হারুনকে জানায়। তখন হারুন তাদের হাতিরঝিলে একটি বাসার ঠিকানা বলে দেয় এবং মাসুমাকে সেখানে নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা ওই বাসার গেট বন্ধ পাওয়ায় তারা মাসুমাকে নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে।
পরে আনুমানিক রাত ১২টার দিকে কাঁচপুর এলাকায় গ্রেপ্তার মাসুদের পরিচিত একটি গ্যারেজে নিয়ে তাকে নির্যাতন করে ও প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে ভুক্তভোগীর কাছে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। সেসময় তার কাছে থাকা নগদ দেড় লাখ টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয় বলে ভুক্তভোগী মাসুমা অভিযোগ করেন।
১৮ আগস্ট ( শুক্রবার) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মাসুমাকে বহনকারী গাড়ি রাজধানীর মাদারটেক এলাকায় নেওয়া হয়। পরে হারুনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে জুমার নামাজ পর্যন্ত তাকে সেখানে রাখা হয়। দুপুরের খাবার সময় হলে মাসুদ, রাজু ও সাব্বির হোটেলে যায়। সেসময় পনু, সাইফুল ও শান্ত গাড়ি পাহারায় থাকেন। তারা খাবার নিয়ে ফিরলে সুযোগ বুঝে মাসুমা বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার শুরু করলে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে সাইফুল, সাব্বির ও রাজুকে আটক করে। সেসময় মাসুদ, পনু ও শান্ত কৌশলে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। পরে পুলিশ এসে মাসুমাকে হেফাজতে নেয় এবং সাইফুল, সাব্বির ও রাজুকে গ্রেপ্তার করে তাদের কাছ থেকে ভুক্তভোগীর ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করে।
অপহরণের মূল হোতারা
র্যাব কর্মকর্তা বলেন, গ্রেপ্তার মাসুদ গত ২৫ বছর ধরে গাড়ি চালান। ইতোপূর্বে বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরনের ভারী যানবাহন চালিয়েছেন তিনি। বাস চালানোর সময় একটি সড়ক দুর্ঘটনায় কয়েকজনের নিহতের ঘটনায় তার নামে মামলা হলে তার ভারী যান চালানোর লাইসেন্সটি বাতিল হয়। এছাড়াও তিনি গাড়ি চুরিসহ এলাকায় বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
এনবিআর কর্মকর্তাকে অপহরণের পর মাসুদ রাজধানীর বাবু বাজার এলাকায় তার এক বন্ধুর বাসায় এবং গাজীপুরের শ্রীপুর এলাকায় এক আত্মীয়ের বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন। পরে গাজীপুরের শ্রীপুর এলাকা থেকে মাসুদকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
গ্রেপ্তার পনু পেশায় একজন সিএনজিচালক। একই এলাকায় বসবাস করার কারণে মাসুদের সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। গ্রেপ্তার হাফিজ দূরপাল্লার বাস চালাতেন। ২০২২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সিলেট যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে তার চাকরি চলে যায়। একই পেশা এবং একই এলাকায় বসবাসের কারণে মাসুদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল।
গ্রেপ্তার আসামিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এবং পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে বলেও জানান র্যাব কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
ভুক্তভোগীর সাবেক স্বামীর নির্দেশে এই অপহরণের ঘটনা ঘটলেও তাকে কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামি মাসুদ জানিয়েছে, ক্ষোভ থেকে এবং মাসুমার আগের স্বামীর প্রলোভনে পড়ে তারা এই অপহরণের ঘটনা ঘটিয়েছে। তাদের দেওয়া এসব তথ্য ভুক্তভোগীর করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে জানানো হবে। আসামির দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।