বিদেশে অবস্থান করা একেকজন কিডনি ক্রেতা জীবন বাঁচাতে ৪৫ থেকে ৫০ লাখ টাকা খরচ করে কিডনি কিনে থাকেন। অথচ এই টাকার মাত্র চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা পায় প্রতারিত কিডনি দাতা। পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকার ভাগবাটোয়ারা হয় দেশের সক্রিয় দালাল, অসাধু ট্রাভেল এজেন্ট এবং অন্যান্য প্রতারকদের মধ্যে। বাকি প্রায় ৩০ লাখ টাকা পায় বিদেশে অবস্থানরত কিডনি পাচার সিন্ডিকেট।
দেশে সক্রিয় অবৈধভাবে কিডনি কেনাবেচা চক্রের অন্যতম মূলহোতা মো. আনিছুর রহমানসহ (২৯) জড়িত ৫ জনকে গ্রেপ্তারের পর এসব কথা জানিয়েছে র্যাব-১। গ্রেপ্তারকৃত অন্যরা হলেন, মো. আরিফুল ইসলাম ওরফে রাজিব (৩৩), সালাউদ্দিন তুহিন (২৭), এনামুল হোসেন পারভেজ (কিডনি দাতা) ও সাইফুল ইসলাম।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও গোয়েন্দা তৎপরতার ধারাবাহিকতায় গতকাল বুধবার রাজধানীর ভাটারা, বাড্ডা, বনানী ও মহাখালী এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসময় তাদের নিকট থেকে অঙ্গিকারনামা এবং ভুক্তভোগীর সঙ্গে করা চুক্তির এফিডেভিট কপি উদ্ধার করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ২০ জুলাই দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব-১ অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোস্তাক আহমেদ।
নিজের কিডনি খুইয়ে আনিসুর গড়ে তোলেন চক্র
র্যাব জানায়, ২০১৯ সালে চিকিৎসার জন্য ভুয়া কাগজপত্রে ভারতে গিয়ে অর্থের বিনিময়ে নিজের একটি কিডনি বিক্রি করেন আনিছুর রহমান। সেখানে কিডনি প্রতিস্থাপনের ব্যাপক চাহিদা দেখে প্রলুব্ধ হয়ে দেশে ফিরে নিজেই নামে কিডনি বেচাকেনার অবৈধ ব্যবসায়।ভারতের কিডনি ক্রয়-বিক্রয় চক্রের সহযোগিতায় একটি দালাল চক্র গড়ে তুলেন। অনলাইনে বিত্তশালী কিডনি রোগী এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে কিডনি ডোনার সংগ্রহ করে বৈধ ও অবৈধভাবে বিমানে বা স্থলপথে ভারতে পাঠাতেন তিনি।
আনিছুরকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে র্যাব জানায়, এখন পর্যন্ত তার মাধ্যমে ৫০ এর বেশি কিডনি বিক্রি হয়েছে। প্রতারণার মাধ্যমে মানবদেহের কিডনিসহ নানাবিধ অঙ্গের অবৈধ ট্রান্সপ্লান্টেশনের সঙ্গে সক্রিয় রয়েছে কয়েকটি চক্র। এসব চক্রের ফাঁদে প্রলুব্ধ হয়ে সর্বহারা হচ্ছে অসহায় নিম্নআয়ের মানুষ।
টাকার লোভে কিডনি হারায় নিম্নআয়ের মানুষ
র্যাব-১ অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোস্তাক আহমেদ বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে দরিদ্র সীমার নীচের অসহায় মানুষগুলোকে টার্গেট করে প্রতারণার ফাঁদ পাতে এই চক্র। কখনও তারা বলে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে একটির বেশি কিডনি দরকার নেই, কখনও মিথ্যা আশ্বাস দেয় যে চিকিৎসার খরচ তারা বহন করবে। টাকার লোভে কিডনি হারিয়ে প্রায়ই অকর্মণ্য হয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে ঢলে পরে অসহায় মানুষগুলো।
চারটি চক্রে ভাগ হয়ে কার্যক্রম
কিডনি চক্রের কার্যক্রম সম্পর্কে র্যাব-১ অধিনায়ক বলেন: চক্রটি চারটি ভাগে বিভক্ত হয়ে কাজ করে। প্রথম গ্রুপ বিদেশে অবস্থান করে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রয়োজন এমন বিত্তশালী রোগীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে। দেশে থাকা মূলহোতা আনিছ ঢাকায় বসে বিদেশে ডোনার পাঠানোর বিষয় তদারকি করে।
চক্রের তৃতীয় দলটির সদস্য আরিফ এবং তুহিন প্রথম দলের চাহিদা মোতাবেক দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরীব ও অভাবী মানুষদের চিহ্নিত করে এবং তাদের অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অর্থের বিনিময়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন এর জন্য ডোনার হতে প্রলুব্ধ করে ঢাকায় নিয়ে আসে। পরে ঢাকার বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রত্যাশী রোগীর সাথে ব্ল্যাড ম্যাচিং এবং অন্যান্য পরীক্ষা নিরীক্ষা সম্পন্ন করে। ব্ল্যাড ম্যাচিং এবং অন্যান্য টেস্টে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের উপযুক্ততা নিশ্চিত হলে, চতুর্থ গ্রুপটির হোতা ‘সাহেবানা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস’-এর মালিক সাইফুল ইসলাম প্রলোভনের শিকার ভুক্তভোগী কিডনি দাতাদের পাসপোর্ট, ভিসা প্রসেসিং এবং ভুয়া কাগজপত্র তৈরির মাধ্যমে ভুক্তভোগী কিডনি দাতাকে ভারতে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করে।
বিএসএমএমইউতে কিডনি প্রতিস্থাপনে চক্রটি জড়িত নয়
ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে (এসএসএইচ) সোমবার পিরোজপুরের এক ব্যক্তির কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। তার ছোট ভাই সুসেন রায় এই কিডনি দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছিল বিএসএমএমইউ।তবে বুধবার সংবাদ মাধ্যমে খবর আসে, কিডনি দানকারী ব্যক্তি সুসেন রায় নন, সুমিত হাওলাদার নামে অন্য ব্যক্তি।এই প্রতারণার সঙ্গে গ্রেপ্তার চক্রটি জড়িত কি না এমন প্রশ্নের জবাবে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোস্তাক আহমেদ বলেন, তাদের জড়িত থাকার এমন কোনো তথ্য আমরা পাইনি।
চক্রের সকল কাগজপত্র জাল
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোস্তাক আহমেদ বলেন, অন্য কোন চক্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আমরা পায়নি। তবে দেশের ভেতর তারা দীর্ঘদিন ধরে কিডনি বেচাকেনা নিয়ে কাজ করছিল। চক্রটি এখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে কিডনি নিয়েছে।
মূলত এসব চক্র মোবাইল ফোন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণার কাজ করে আসছে। আমরা বেশকিছু পেইজ নজরদারি করছি; ধারণা করছি এসব কাজে আরও বেশকিছু চক্র জড়িত রয়েছে।
কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা অন্য কেউ চক্রের সঙ্গে জড়িত আছে কি না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, না আমরা এমন কাউকে পাইনি। তাদের কাছে যেসব কাগজপত্র পেয়েছি সেগুলো জাল। এগুলো জাল-জালিয়াতির মাধ্যমেই তৈরি করেছে যা দিয়ে ভিসা পাবার ব্যবস্থা করতো। এরসঙ্গে কোনো হাসপাতালের সম্পৃক্ততা পাইনি।একেক জনের সঙ্গে একেক ধরণের চুক্তি করে কিডনি প্রতিস্থাপন করতো। সেই টাকা কীভাবে ভাগ হতো? এমন প্রশ্নের উত্তরে মোস্তাক আহমেদ বলেন, জানা গেছে- প্রাথমিকভাবে ৫০ লাখ টাকা চুক্তি হতো। সেই টাকার মধ্যে যিনি কিডনি দিতেন তিনি চার থেকে পাঁচলাখ টাকা পেতেন। বাকি টাকা চক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে বন্টন হতো।