কোপা কাপ থেকে বিশ্বকাপের মতো আলো ঝলমলে উত্তেজনাময় মঞ্চ। সেই মঞ্চে এখন ভীষণ আলোকিত এক নাম এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। আর্জেন্টিনার গোলপোস্টের অতন্দ্রপ্রহরী। জাতীয় দলের হয়ে এপর্যন্ত ২৪টি ম্যাচ খেলেছেন। এই বিশ্বকাপের শুরু থেকেই নিয়মিত খেলছেন। তবে ৯ ডিসেম্বর নিজেকে আরও নান্দনিকভাবে চিনিয়েছেন এমি।
অসাধারণ সেভের কারণেই কোয়ার্টার ফাইনালে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ নেদারল্যান্ডসকে ৪-৩ গোলের ব্যবধানে পরাজিত করে সেমিফাইনালে উঠে আসে আর্জেন্টিনা। টাইব্রেকারে সেদিন নেদারল্যান্ডসের নেওয়া প্রথম দুটি শট দৃঢতার সাথে রুখে দেন মার্টিনেজ। তাতেই আলবিসেলেস্তেদের জয়ের পথ প্রশস্ত হয়। কোপা কাপের পর কাতার বিশ্বকাপেও মার্টিনেজ দেখালেন তিনি অগ্রজ গয়কোচিয়ারই প্রকৃত এক ছায়া। তাকে টাইব্রেকারে পরাস্ত করা অত সহজ নয়। আর্জেন্টিনার ভক্তদের কাছে তাই তিনি এখন প্রিয় এক নাম।
একজন দক্ষ গোলরক্ষকের মধ্যে পাওয়ার, নিখুঁত মুভমেন্ট, অনবদ্য স্কিল, ব্যালান্স, অসাধারণ ডাইভ করার মতো যে যে গুণাবলী থাকা দরকার তা এমির মধ্যে দৃশ্যমান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্টিনেজের মধ্যে এসব গুণাবলী বা উপকরণের উপস্থিতি চমৎকার। আর্জেন্টিনা এখন শতভাগ ভরসা করে তাকে। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে রেখেছেন সেই মান। গোলমুখে ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। নিজেদের গোলপোস্ট মার্টিনেজ যেভাবে আগলে রাখছেন ঠিক সেভাবে ’৯০-এর বিশ্বকাপে ভীষণরকম আলোচিত হয়েছিলেন আর্জেন্টিনার গয়কোচিয়া।
আশির দশকে আর্জেন্টিনার গোলপোস্টে দাঁড়ানো নেরি পাম্পিডো এবং সার্জিও গয়কোচিয়া নিশ্চয় আমাদের স্মৃতিপট থেকে হারিয়ে যায়নি। বিশেষ করে অভিমানী চেহারার ধীর-স্থির ঠাণ্ডা মেজাজের গয়কোচিয়া এখনও আর্জেন্টিনা ভক্তদের হৃদয়ে ছবির মতো আটকে আছে। ’৯০-এর বিশ্বকাপে গয়কোচিয়া চীনের প্রাচীরে সদৃশ ছিলেন। তাকে ভেদ করা অতো সহজ ছিল না।

নব্বইয়ের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার গয়কোচিয়ার গোলপোস্ট আগলানো আর প্রতিপক্ষকে ফিরিয়ে দেওয়া ছিল বড় এক বিনোদন। বিশেষ করে পেনাল্টি শুট আউট ফিরিয়ে দিয়ে তিনি নতুন আইকনে পরিণত হয়েছিলেন। অসাধারণ সব পেনাল্টি শুট ঠেকিয়ে দেওয়ার কারণেই সেবার ম্যারাডোনার দল ফাইনালে উঠেছিল।
১৯৯০ সালের ৩০ জুনের কথা মনে করা যাক। সেদিন কোয়ার্টার ফাইনালের খেলায় আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হয়েছিল যুগোস্লাভিয়া। টাইব্রেকারে যুগোস্লাভিয়াকে ৩-২ গোলের ব্যবধানে পরাজিত করে আর্জেন্টিনা। সেই জয়ে মূল নায়ক ছিলেন গোলরক্ষক গয়কোচিয়া। এরপর ৪ জুলাই সেমিফাইনালে ইতালির সাথে ম্যাচও গড়ায় টাইব্রেকারে। গোলরক্ষক গয়কোচিয়ার প্রত্যুৎপন্নতায় এ ম্যাচে ৪-৩ গোলে জয়ী হয় আর্জেন্টিনা। সেসময় খুশির জোয়ারে ভেসেছিলেন আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা।
গয়কোচিয়া আর্জেন্টিনার কোটি কোটি ভক্তদের মন জয় করে নিয়েছিলেন সহসাই। তার বিদায়ের পর আর্জেন্টিনার কোনো গোলরক্ষকই যে আর গোলপোস্টে দাঁড়িয়ে তেমন নির্ভরতার পরিচয় দিতে পারেনি তা বলাই বাহুল্য। বরং গোলপোস্ট নিয়ে আর্জেন্টিনার ভক্তদের আক্ষেপ থেকেই গেছে। রেকর্ডপত্র খুঁজলে দেখা যাবে শুধুমাত্র গোলরক্ষকের কারণেই আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের অশ্রুসিক্ত হয়ে মাঠ ত্যাগ করতে হয়েছে বহুবার।
মাঝে আর্জেন্টিনার গোলপোস্টে কিছুটা নির্ভরতা তৈরি করেছিলেন সার্জিও রোমেরো। এরপর বিগত কয়েকবছরে ফ্রাংকো আরমানি, নাহুয়েল গুজম্যান, উইলি ক্যাবেলেরো কেউ-ই তেমন তারকাচিত পারফরম্যান্স উপহার দিতে পারেনি। কিন্তু গয়কোচিয়ার ছায়া নিয়ে বোধ হয় এসেছেন আর্জেন্টিনার গোলপোস্টের নতুন প্রহরী এমিলিয়ানো মার্টিনেজ।
সর্বশেষ ২০২১ সালে ৭ জুন অনুষ্ঠিত কোপা আমেরিকা শিরোপার সেমিফাইনালের দিনটির কথা মনে করা যাক। সেদিনই তার অসাধারণ সেইভের কারণেই আর্জেন্টিনাকে আর নতুন করে অশ্রুতে ভাসতে হয়নি। শেষ চারে সেদিন আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল কলম্বিয়া। ম্যাচে লিওনেল মেসির দল শুরুতে লিড নিলেও কলম্বিয়ার ধারালো আক্রমণে খেলায় সমতা ফেরে। শেষ পর্যন্ত ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে।
বিগত দিনের অভিজ্ঞতায় আর্জেন্টিনা শিবির কিছুটা অশনি সংকেত কড়া নাড়ছিল। কিন্তু না, গোলরক্ষক মার্টিনেজ তিন তিনটি শুট সেভ করেন নান্দনিক ভঙ্গিমায়, অসাধারণ ডাইভে। শেষে জয়ী হয় আর্জেন্টিনা। শেষে কোপার খরা কাটিয়ে শিরোপাও ঘরে তুলে নেয় আলবিসেলেস্তেরা।
কলম্বিয়ার বিপক্ষে সেদিন জয়ের নায়ক ছিলেন নিঃসন্দেহে গোলরক্ষক মার্টিনেজ। অথচ এর কিছুদিন আগেও তিনি ছিলেন অচেনা, অর্বাচীন বা মুসাফির। কোপাতেই প্রথমবার কোচ লিওনেল স্কালোনি তার জন্য অবারিত সুযোগ উন্মুক্ত করেন। অথচ ধারের (লোন) খেলোয়াড় হিসেবেই ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে মার্টিনেজের বছরের পর বছর সময় কেটে গেছে। কিন্তু না কোপা কাপের মধ্যে দিয়েই তিনি বিশ্বময় পরিচিত হয়ে উঠেন।
কলম্বিয়ার সাথে এমির অসাধারণ পারফরম্যান্সের কারণে সেসময় অনেকেই সেই পুরনো স্মৃতি, মানে গয়কোচিয়া কালের স্মৃতিতে অবগাহন না করে পারেননি। ফুটবল বিশেষজ্ঞ আর আর্জেন্টাইন ভক্তরা তখনই বুঝে ফেলেন এতদিন পর আর্জেন্টিনা পায়ের নিচে অন্তত একখণ্ড শক্ত মাটি পেয়েছে।
আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের হয়ে কোপাতেই কিন্তু প্রথম মাঠে নেমেছিলেন মার্টিনেজ। এর আগে জাতীয় দলে দু’এক দফা ডাক পেলেও মাঠে নামতে পারেননি। অতিরিক্ত গোলরক্ষক হিসেবে রিজার্ভ বেঞ্চে বসে থাকতে হয়েছে। ২০২১ সালে সর্বশেষ কোপা কাপের আয়োজনে ৩ জুন চিলির বিপক্ষে অভিষেক ঘটেছিল। প্রথম ম্যাচে অবশ্য অপরাজেয় থাকতে পারেননি। ড্র হওয়া ম্যাচে তাকে ৩৬ মিনিটে পরাভূত করে চিলির সানচেজ। এরপর প্রতিটি ম্যাচেই মার্টিনেজকে দেখা যায় আস্থা ও দৃঢ়তার সাথে খেলতে।
মার্টিনেজের জন্ম বুয়েন্স আয়ার্সের মার ডেল প্লাটাতে ১৯৯২ সালের ২ সেপ্টেম্বরে। তবে মোটেও সোনার চামচ মুখে নিয়ে নয়, জন্ম গরিব পরিবারে। যে পরিবারের নুন আনতে পান্তা ফুরাতো। মার্টিনেজ নিজ চোখে দেখেছেন তার বাবা আলবার্ট বিভিন্ন বিল শোধ করতে না পেরে কাঁদছেন। অনেক রাতেই তাদের টেবিলে খাবার থাকতো না। এ কারণেই মার্টিনেজ নিজ পরিবারের ভাগ্য বদলের শপথ নেন।
৩০ বর্ষী এমির ফুটবল ক্যারিয়ারের সূচনা হয় আর্জেন্টিনার পেশাদার ফুটবল দল অ্যাটলেটিকা ইনডিপেনডিন্টের হয়ে। এরপর ২০১১ সালে ইংল্যান্ডে এসে যোগ দেন আর্সেনালে। কিন্তু ভাষাগত (ইংরেজি একটুও না জানা) সমস্যা তার চলার পথে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ভাগ্যেও যেন গিঁট পড়ে। মাঠে নামার সুযোগ আর আসে না।
এরমধ্যে বিভিন্ন ক্লাবে খেলেন ধার করা গোলরক্ষক হিসেবে। এই ধারাবাহিকতায় পেশাদারী ফুটবলে মার্টিনেজের মাঠে অভিষেক হয় ১২ সালের ৫ মে অক্সফোর্ড ইউনাইটেড ক্লাবের হয়ে। অক্সফোর্ড ইউনাইটেড আর্সেনাল থেকে ধারে (লোন) নেয়। অবশ্য ২০১৯ সালে ভাগ্য কিছুটা খোলে মার্টিনেজের। আর্সেনালের হয়ে ন্যাশনাল কাপে খেলার সুযোগ পান।
নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পরের বছর মার্টিনেজ ২০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে যোগ দেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের অ্যাস্টন ভিলাতে। ক্লাবটির হয়ে মাঠে অভিষেক ঘটে ওই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর। এরপর প্রথম ম্যাচ সেফিল্ড ইউনাইটেডের বিপক্ষে খেলতে নেমেই গোলপোস্টে চমক দেখান। এ ম্যাচে তিনি একটি পেনাল্টি রুখে দেন। অ্যাস্টন ভিলার হয়ে এপর্যন্ত মোট ৮৯টি ম্যাচ খেলেছেন।
ক্লাব ফুটবল ছাপিয়ে জাতীয় দলের জার্সিতেও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে উঠেছেন এমি। বিশ্বকাপে স্কালোনির আস্থার প্রতিদান দেওয়া গোলরক্ষক আছেন ফর্মের তুঙ্গে। ‘বাজপাখি’খ্যাত এমি কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে দিতে ছিলেন নায়কের ভূমিকায়। সেমিতে ক্রোয়েটদের আক্রমণও সামলেছে তার বিশ্বস্ত গ্লাভস। ফাইনালেও তার উপর পূর্ণ আস্থা রাখবেন স্কালোনি-মেসি, আশায় চেয়ে থাকবেন আর্জেন্টিনার সমর্থকরা। আস্থার প্রতিদান দিতে পারবেন কিনা ‘বাজপাখি’ মার্টিনেজ, তা জানিয়ে দেবে সময়।