নিষ্ঠুর সব নাটকীয়তার মধ্যে দিয়ে কাল দ্বিতীয় কোয়ার্টার ফাইনালে জয়ী হয়ে আর্জেন্টিনা যেমন উঠে এসেছে সেমিফাইনালে, তেমনি কোয়ার্টার ফাইনালের শ্বাসরুদ্ধকর প্রথম ম্যাচের লড়াই-এ পরাজিত হয়ে ব্রাজিল বিদায় নিয়েছে বিশ্বকাপ থেকে।
কাল রাত ছিল ভীষণ উত্তেজনাময়, উপভোগ্য এবং রোমাঞ্চকর। প্রতিটি মুহূর্তেই যেন সব বদলে যাচ্ছিল। রাতের প্রথম ম্যাচে ব্রাজিল অতিরিক্ত সময়ের ১০৫ মিনিটে নেইমারের অসাধারণ এক গোলে এগিয়ে গিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল কার্যত নিশ্চিত করেই ফেলেছিল। কিন্তু খেলা শেষ হওয়ার মাত্র তিন মিনিট আগে ১১৭ মিনিটের সময় ক্রোয়েশিয়ার পক্ষে পাল্টা আক্রমণ থেকে গোল করেন ব্রুনো পেতকোভিচ। স্বভাবতই অতিরিক্ত সময় শেষ হলে ম্যাচ চলে যায় টাইব্রেকারে। কিন্তু ব্রাজিলের ভাগ্য দরজা আর খোলেনি। পেনাল্টি শুটআউটে ক্রোয়েশিয়ার খেলোয়াড়দের নির্ভুল নিশানায় পরাজিত হতে হয় ব্রাজিলকে। আর ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষক টাইব্রেকারে অসাধারণ দুটি সেভ করে নিজ দেশকে সেমিফাইনালে নিয়ে যেতে বড় ভূমিকা রাখেন। গোলরক্ষক লিভাকোভিচ ম্যাচে ১১টি অসাধারণ সেভ করে ব্রাজিলের সব স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দেন। বিপরীতে নিষ্ঠুর এক নাটকীয় গল্পের মধ্যে শেষ হয় ব্রাজিলের বিশ্বকাপ মিশন।
প্রথম ম্যাচের মতো আবার দ্বিতীয় ম্যাচও আরও অতি নাটকে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। আর্জেন্টিনা যখন ২-১ গোলে জয়ের প্রায় শেষ প্রান্তে তখন মাত্র কয়েক সেকেন্ড আগে ডাচ তারকা ওয়েঘর্স্ট ফ্রি-কিক থেকে পাওয়া বলে মুহূর্তেই টাচ দিয়ে বল জালে পাঠিয়ে দিয়ে খেলায় সমতা ফিরিয়ে আনলে নাটক জমে উঠে। ডাচদের এই নিষ্ঠুর গোলের মধ্যে দিয়ে যেন আর্জেন্টিনারও বিদায়ের প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়।
এরপর অতিরিক্ত সময়ে আর্জেন্টিনা তুলনামূলক ভালো খেলে আক্রমণ শানালেও সব বৃথা হয়ে যায় ভাগ্যের ফেরে। এমন কী ফের্নান্দেজের নেওয়া একটি অসাধারণ শট পোস্টে লেগে ফিরে আসে। শেষমেশ এ ম্যাচের ভাগ্যও নির্ধারিত হয় টাইব্রেকারে। কিন্তু ব্রাজিলের মতো আর্জেন্টিনার আর নির্মমতার শিকার হতে হয়নি। গোলপোস্টের অতন্দ্রপ্রহরী এমিলিয়ানো মার্টিনেজ ডাচদের প্রথম শটটি রুখে দিয়েই আর্জেন্টিনার জয়ের পথ উন্মুক্ত করেন। দ্বিতীয় শটও তিনি একইভাবে আটকিয়ে দেন। সবশেষে লৌতারো মার্টিনেজ গোল করে আর্জেন্টিনাকে আনন্দে ভাসিয়ে দেয়।
গতরাতের পর আজকের দুটি কোয়ার্টার ফাইনাল নিয়েও চলছে রাজ্যের আলোচনা। কী হবে আজ রাতে? আজ প্রথম ম্যাচে রাত ৯টায় মুখোমুখি হবে এই বিশ্বকাপে ত্রাস ছড়ানো মরক্কো এবং পর্তুগাল। রাত ১টায় দ্বিতীয় ম্যাচে লড়বে সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ড। উল্লেখিত দুটি ম্যাচের প্রতিটি দলই শক্তিশালী এবং সংঘবদ্ধ। কিন্তু আজ সবার মূল নজরটা থাকছে মরক্কো এবং ফ্রান্সের দিকে।
দ্বিতীয় রাউন্ডের আগেই স্পেনের কোচ লুইস এনরিকের এক বক্তব্যের জবাবে মরক্কোর কোচ ওয়ালিদ রেগ্রাগুই বলেছিলেন, ‘আমরা বিশ্বকাপ নিতে এসেছি, অন্যকিছু নয়।’ দ্বিতীয় রাউন্ডে স্পেনকে বিদায় করে দিয়েছে মরক্কোই। এই বিশ্বকাপে অন্যতম দুই শক্তিশালী দল বেলজিয়াম এবং স্পেনকে হারানোর অনন্য কৃতিত্ব তাদের। ফুটবল বিশেষজ্ঞদের কাছে মরক্কো তাই এখন এক দুর্নিবার শক্তির নাম, আত্মবিশ্বাসের নাম। মরক্কোর কোচও এই একই কথা পুনঃচয়ন করছেন ‘আমাদের আত্মবিশ্বাসই আমাদের মূল শক্তি। আমরা চ্যাম্পিয়ন হতে এসেছি। অন্যকিছু নিয়ে ভাবছি না।’
আজ পর্তুগালের বিপক্ষেও তাই মরক্কো ভীষণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে চড়াও হবে বলে মনে করেন আশির দশকের তারকা ফুটবলার স্বপন দাস। ‘মোহামেডানে স্বপন’ নামে তিনি এখনও পুরনোদের কাছে প্রিয় এক নাম। জাতীয় দলের হয়েও খেলেছেন অনেকদিন। ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পর কোচিং পেশার সাথেও যুক্ত হয়েছিলেন। স্বপন দাস মনে করেন গত রাতে দুটি কোয়ার্টার ফাইনালে যা যা ঘটেছে আজও তাই হবে। প্রথম ম্যাচে তিনি এগিয়ে রাখছেন মরক্কোকেই। তার মতে, ‘আজকেও মিরাকল কিছু ঘটাতে পারে মরক্কো, সেই সামর্থ্য তারা প্রমাণ করেছে। এই দলটির খেলায় অসাধারণ গতি লক্ষণীয়। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে ভালো ফিনিশিং যারা দিতে পারবে তাদের জন্য জয়টা ধরে রাখা সম্ভব হবে।’
অনেকের মতো স্বপন দাসও মনে করেন মরক্কো টিম আসলেই আত্মবিশ্বাসী এক টিম। শেষ মিনিট পর্যন্ত মরণপণ লড়াই-এর অঙ্গীকার তাদের মধ্যে দৃশ্যমান। জেতার যে অদম্য ইচ্ছে এটি তারা বারবার প্রমাণ করেছে বিগত ম্যাচগুলোতে। তবে পর্তুগাল আজ কী কৌশলে মরক্কোকে ঘায়েল করবে সেটাই দেখার বিষয়।
তিনি বলেন, ‘পর্তুগালের খেলোয়াড়দের স্কিল ভালো। দ্রুত পাস করে খেলে। আবার বলের নিয়ন্ত্রণে মরক্কোও বেপরোয়া। পর্তুগালের টিম সিলেকশনে রোনালদোকে নিয়ে যে ঝামেলা তৈরি হয়েছে তার বেনিফিটও পেতে পারে মরক্কো। আর মাঠের বাইরে ডাগআউটে থাকা কোচ ওয়ালিদ কিন্তু প্রতিটি ম্যাচেই বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে এসেছে। আজ সেই বিচক্ষণতা আরও পরিপূর্ণতা পেতে পারে। বিপরীতে পর্তুগাল অবশ্যই ভালো। তবে মাঠ নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারলে মরক্কো অনেক অ্যাডভানটেজ পাবে।’
ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের মধ্যেকার ম্যাচেও হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে মনে করেন স্বপন দাস। তবে তিনি জয়ের ক্ষেত্রে বেশি এগিয়ে রাখছেন ফ্রান্সকেই। তিনি বলেন, ‘ফ্রান্সে এমবাপে, জিরুদ, গ্রিজম্যান মিলে যে অপূর্ব সমন্বয় সেটি ভয়ঙ্কর। যেকোনো সময় তারা গোল বের করার সুযোগ তৈরি করে ফেলবে। বিপরীতে ইংল্যান্ড প্রতিটি ম্যাচ ভালো খেলে উঠে এসেছে এটি তাদের প্রাণশক্তিতে বড় অনুপ্রেরণা। এই ম্যাচে যারা গোলের সুযোগ মিস করবে তাদের কপাল পুড়তে পারে। চরম উত্তেজনাপূর্ণ হবে এই ম্যাচ-ফলাফলের জন্য তাই শেষ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
সবশেষে স্বপন দাস বলেন, গতকাল ডি-বক্সের বাইরে থেকে গোল হয়েছে কম। আজ হয়ত দৃশ্যটা পাল্টে যাবে। ডি-বক্স প্যাক্ট করার বদলে ফাঁকা করার কৌশলে গোল প্রবণতা দেখা যাবে। যদি সত্যিই মরক্কো আর ফ্রান্স সেমিফাইনালে উঠে আসে তাহলে সেমিফাইনালে হবে আরও নাটকীয় সব কাণ্ডকারখানা।