চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

যে পথে খুলল আর্জেন্টিনার ফাইনালের দুয়ার

কাতার বিশ্বকাপের শুরুতেই হোঁচট, পরে আঙুলের কড়ে গুণে গুণে প্রতিটি ম্যাচে বীরের মতো খেলে শেষ ষোলো। তারপর কোয়ার্টার, সেমিফাইনালে আলো ছড়িয়ে ফাইনালে। এরপর…! ফ্রান্সকে হারিয়ে বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরতে পারবে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা? গল্পের শেষটা জানতে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা। যে মঞ্চে আসতে কম চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়নি লিওনেল স্কালোনির শিষ্যদের।

বাদ পড়ার শঙ্কা, ‘এই বুঝি বাজল বিদায়ঘণ্টা’, প্রতিটি ম্যাচই নকআউটে রূপ নেয়া, সব টপকে আলবিসেলেস্তেরা শেষপর্যন্ত পাশার দানটা মিলিয়ে দিয়েছে। পথে পথে কত কথা, বন্ধুর সেই পথ পেরোতে কত শত গল্প। অঘটনের হার দিয়ে শুরু করা বিশ্বকাপে শিরোপা উঁচিয়ে ধরা থেকে এককদম দূরত্ব।

রোলার কোস্টারে চেপে সেই গল্পই শোনা যাক আবারও। ঘুরিয়ে দেখা যাক গ্রুপপর্ব থেকে ফাইনালে আসা পর্যন্ত আর্জেন্টিনার প্রতিটি ম্যাচের খুঁটিনাটি।

সৌদি আরবের বিপক্ষে গ্রুপপর্বে অঘটন
ততক্ষণে ফুটবল পাড়ায় ‘গেল গেল রব উঠে গেছে’, আর্জেন্টিনা কিনা শেষে সৌদির মতো দলের কাছে আটকে গেল। মেসির বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন ও টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড নিয়ে তখন কাটাছেঁড়া। ২-১ গোলের হারে স্কালোনির শিষ্যরা যেন ভেঙেচুড়ে চুরমার। এশিয়ার দেশটির জয়টিকে অঘটনই বলা হয়েছে। তাছাড়া অফসাইডের ফাঁদে ভালো করেই পড়েছিল লিওনেল মেসিরা।

টানা অফসাইডের পতাকা না তুললে ফল হয়ত ভিন্ন হতো। আর্জেন্টিনার এক হালি গোল অফসাইডে বাতিল হয়ে যায়। লুসেইল স্টেডিয়ামে গ্রুপ ‘সি’র সেই খেলার পেনাল্টি থেকে দলকে এগিয়ে দেন মেসি। ৪৮ মিনিটে সৌদি ফরোয়ার্ড সালেহ আল-শেহরি আনেন প্রথম গোল, ৫৩ মিনিটে মিডফিল্ডার সেলিম আল-দাসারি বাড়ান লিড। সেটিই নির্ধারণ করে দেয় ম্যাচের ভাগ্য। হারের পর মেসি জানান, এভাবে শুরু চাননি। এমন হার শিরোপা জয়ের মিশনে ‘চরম আঘাত’ জানিয়ে বলেন, ‘এই হারটা কষ্ট দিচ্ছে।’

মেক্সিকোকে হারিয়ে আশায় বাঁচা
ততক্ষণে অনেকে খাতা-কলম নিয়ে বসে গেছেন। কেউ কষছেন, কিভাবে বাদ পড়বে অন্যতম ফেভারিট দলটি। কারও কামড়ানো কলমে লেখা হচ্ছে কোনমতে পরের রাউন্ড নিশ্চিতের ক্ষীণ সম্ভাবনা। হম্বিতম্বির শেষ ছিল না মেক্সিকোর, ইতিহাস-পরিসংখ্যান ঘেঁটে তারাও ছিল প্রত্যয়ী। তবে এক মেসির সামনে শেষ হয়ে গেল মেক্সিকানরা। ২-০ গোলের জয়ে আসরে টিকে থাকার ৩ পয়েন্ট সংগ্রহে আনে আলবিসেলেস্তেরা।

গ্রুপ টেবিলে তখনও ভয়ানক চাপে মেসির আর্জেন্টিনা। গ্রুপের শেষ ম্যাচে পোল্যান্ডকে হারাতেই হবে, এর বাইরে আর কোনো সমীকরণ নেই। হারলে বিনা বাক্যব্যয়ে বিদায়, ড্র করলেও তাকিয়ে থাকতে হবে মেক্সিকো-সৌদি ম্যাচে। এমন ম্যাচের আগে কাজের কাজটা করে দেন মেসি-এনজো। দুরন্ত মেক্সিকোর বিপক্ষে ৬৪ মিনিটে মেসির গোলের পর ৮৭ মিনিটে এনজো ফের্নান্দেজের গোলে আসে পূর্ণ তিন পয়েন্ট।

পোল্যান্ডকে নিয়ে শেষ ষোলো
একইদিনে একই সময়ে গ্রুপের চার দলের খেলা। প্রত্যেকের সামনেই নকআউটে ওঠার সুযোগ। মেক্সিকোর বিপক্ষে জেতায় অবশ্য আর্জেন্টিনার জন্য সমীকরণটা আগের থেকে খানিকটা সহজ হয়েছে। তবুও সব হিসেব-নিকেশ একদিকে রেখে জয়ের বিকল্প ভাবতে পারছে না আর্জেন্টিনা। নক আউটে রূপ নেয়া ম্যাচে শুরুতেই পেনাল্টি মিস করে বসলেন মেসি।

কিন্তু ফুটবল দেবতা ততক্ষণে নাটক জমিয়ে রেখেছেন। আধিপত্য রেখে আর্জেন্টিনা জিতে গেল ২-০ গোলে। ৪৬ মিনিটে ম্যাক অ্যালিস্টারের পর ৬৭ মিনিটে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন জুলিয়ান আলভারেজ। সি-গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন হয়ে শেষ ষোলো নিশ্চিত করে আলবিসেলেস্তেরা। আরেক ম্যাচে সৌদিকে হারিয়েও গোল পার্থক্যে বাদ পড়ে মেক্সিকো। আর্জেন্টিনার সঙ্গী হয়ে পরের রাউন্ডে যায় রবার্ট লেভান্ডোভস্কির পোলিশবাহিনী।

শেষ ষোলোয় সামনে অস্ট্রেলিয়া
এই হলে সেই হতো— টাইপের আলোচনা ততদিনে বন্ধ। শুরুর পর থেকে নকআউটের ফাড়ায় পড়া আর্জেন্টিনাও যেন নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন। হারলেই গোটাতে হবে তল্পিতল্পা, এমন সমীকরণের ম্যাচে তাই নির্ভার ছিল স্কালোনির শিষ্যরা। এশিয়ার দেশ হিসেবে খেলা অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেয় ২-১ গোলের ব্যবধানে, নিশ্চিত করে নেয় কোয়ার্টার ফাইনালের টিকিট।

পঞ্চমবারের মতো বৈশ্বিক আসরে খেলতে আসা মেসি প্রথমবারের মতো পান নকআউট পর্বে গোল, ক্যারিয়ারের হাজারতম ম্যাচে বিশ্বকাপে গোলের হিসেবে ছাড়িয়ে যান কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে। কিন্তু উদযাপনে একেবারেই ম্রিয়মাণ থাকেন মেসি। জয়ের পর ক্যারিয়ারের হাজারতম ম্যাচ নিয়ে বাড়তি উচ্ছ্বাস নেই কেন মেসির? এমএল টেনের সাফ জবাব, ‘না, একদম না। উদযাপনের সময় আসেনি।’ হয়ত আর্জেন্টাইন মহাতারকা আগেই জানতেন, ‘কিছু তো একটা হচ্ছে, সময় আরও বাকি!’

কোয়ার্টার ফাইনালে প্রতিপক্ষ শক্তিশালী ডাচ দুর্গ
কাতার বিশ্বকাপে সবচেয়ে বিতর্কিত বললেও ভুল হবে না আর্জেন্টিনা-নেদারল্যান্ডসের ম্যাচটি। দুদল মিলিয়ে ১৮টি হলুদ কার্ড, ডাচদের একটি লাল কার্ড জোটে। কার্ডের বন্যা বয়ে যাওয়া খেলাটি রূপ বদলেছে বারবার। আকাশী-নীল নাকি কমলা, কোন রঙে রঙিন হবে কাতারের সর্বাধিক ধারণ ক্ষমতার লুসেইল স্টেডিয়াম— নির্দিষ্ট দল বাদে নিরেট ফুটবল সমর্থকদের কাছে জানতে চাইলেও তখন কারো নাম বলার সাধ্যি ছিল না। নির্ধারিত সময় গড়িয়ে অতিরিক্ত সময় হয়ে টাইব্রেকার, সেখানে ‘বাজপাখি’ খ্যাত এমিলিয়ানো মার্টিনেজের দর্শনীয় সব সেভ। ফলাফল শেষ চারের লড়াইয়ে উঠে যায় আর্জেন্টিনা, প্রতিপক্ষও নিশ্চিত হয়— রাশিয়া বিশ্বকাপের রানার্সআপ ‘জমাট রক্ষণের’ ক্রোয়েশিয়া।

রোমাঞ্চে ভরপুর শেষ আটের ম্যাচটি কার্যত অর্থে চুইয়ে চুইয়ে ফেলেছে রোমাঞ্চ। ম্যাচে লিওনেল মেসি গোল করান, সফল স্পট কিকে খুঁজে পান জাল। জয়ের পথেই ছিল আর্জেন্টিনা। শেষদিকে সবকিছুতে বাগড়া দেন নেদারল্যান্ডসের বদলি নামা ওউট ওয়েঘর্স্ট। জোড়া গোল করে ছড়ান রোমাঞ্চ। অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো নাটকীয়তাও থামে ২-২ ব্যবধানে। শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকার। নায়কোচিত মার্টিনেজে ৪-৩ ব্যবধানে জিতে স্বপ্ন ছোঁয়ার আরেকটু কাছে যায় আর্জেন্টিনা।

ক্রোয়েটদের বিপক্ষে একপেশে সেমির লড়াই
অথচ সেমির লাইনআপটা ভিন্নরকম হতে পারত। ক্রোয়েশিয়া বনাম আর্জেন্টিনা না হয়ে হতে পারত ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা। সেটি না হওয়ায় ফুটবলে উত্তাপ কিছুটা কমে বটে! লুসেইলের সুবিশাল স্টেডিয়ামও দেখে অনেকটা একপেশে আক্রমণ আর গোলের ৩-০ ব্যবধানের ম্যাচ। পঞ্চমবারের মতো ফাইনালে উঠে মেসির তো আনন্দ ধরে না, শিশুর মতো নাচলেন। আলবিসেলেস্তেরা ড্রেসিংরুমে গাইলেন, ‘ব্রাজিল কোথায়, ব্রাজিল কোথায়’।

মেসির রেকর্ডময় রাতে গোলমুখে শট রাখার প্রত্যয় দেখায় স্কালোনির শিষ্যরা। বিশ্বকাপে সর্বাধিক ম্যাচ খেলার কীর্তি গড়ার দিনে মেসি পান গোল। ১১ গোল করে স্বদেশি কিংবদন্তি বাতিস্তুতাকে ছাড়িয়ে নিজেকে নিয়ে যান শীর্ষে। ম্যাচে আনেন একটি সহায়তাও। মেসিময় দিনে লাতিন ছন্দে ইউরোপের দলটি হারে ৩-০ গোলে। ২০১৪ সালের পর ট্রফির নিঃশ্বাস দূরত্বে যাওয়ার সুযোগ আনতে মেসির পাশাপাশি বাকি দুটি গোল করেন তরুণ আলভারেজ।

এবং ফাইনাল…
রোলার কোস্টারে শঙ্কা নিয়ে চলা কাতার বিশ্বকাপের শেষটা মধুর করার অপেক্ষায় লিওনেল মেসি। বিশ্বকাপে আর দেখা যাবে না সর্বকালের অন্যতম সেরা মহাতারকাকে। ২০১৪ সালে ব্যর্থ হলেও এবার আর সুযোগ হারাতে চান না। মরক্কোকে হারিয়ে ফাইনালে আসা গতবারের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে হারিয়ে উঁচিয়ে ধরতে চান শিরোপা, স্বপ্নের বিশ্বকাপ ট্রফি।