রাশিয়ার পর কাতার বিশ্বকাপেও ফাইনাল খেলবে ফ্রান্স— এমন ভবিষ্যদ্বাণীতে খুব কম মানুষই বাজি রাখতে পেরেছিলেন। গতবারের চ্যাম্পিয়ন পরেরবার গ্রুপপর্বে বিদায় নেয়, এমন ঐতিহ্য চলছিল। দিদিয়ের দেশমের দলকে ফেভারিটের তালিকায় না রাখার কারণও ছিল যথেষ্ট। নেশনস লিগে ব্যর্থতা এবং চোটে মূল্যবান সব তারকার বিদায়— সব যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছিল!
ভবিষ্যদ্বাণী, হিসেব-নিকেশ ও জল্পনা-কল্পনার অবসান মাঠেই দেখিয়ে দিয়েছেন এমবাপে-জিরুদরা। দাপুটে শুরু করে রেকর্ডের পিঠে রেকর্ড গড়ে এসেছেন শিরোপার মঞ্চে। লুসেইল স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ সময় রোববার রাত নয়টায় লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনার বিপক্ষে তাদের শিরোপা ধরে রাখার মিশন।
তার আগে দেখে নেয়া যাক কোন পথে ফাইনালের মঞ্চে এসেছে ফ্রান্স-
গ্রুপপর্বে দাপুটে শুরু
চোট এবং অসুস্থতার ফাঁদে পড়া ফ্রেঞ্চ দল নিয়ে নানা ধরনের গুঞ্জন চলছিল। বিংশ শতাব্দীর বিশ্বকাপে ঘটে চলা বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন দলের পরের আসরে গ্রুপ পর্বে বিদায়ের ঘটনা ঘটে চলছিল। কিন্তু ফ্রান্স সেই তালিকায় ব্যতিক্রম হতে চলেছে তার প্রমাণ প্রথম ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দাপুটে শুরু করে দিয়েছেন এমবাপে-জিরুদরা। প্রথম ম্যাচ দিদিয়ের দেশমের শিষ্যরা জিতে নেয় ৪-১ ব্যবধানে।
আল জানুব স্টেডিয়ামে আক্রমণ, গোলে শট এবং সবশেষ গোল ব্যবধানেও যোজন এগিয়ে ছিল দিদিয়ের দেশমের শিষ্যরা। ম্যাচের নয় মিনিটে পিছিয়ে পড়লেও এগিয়ে থেকে বিরতিতে যায় ফ্রান্স। পরের অর্ধে দাপুটে ফুটবলের অনন্য শৈলী দেখায়। শেষ অর্ধে বল জালে জড়ায় আরও দুবার। ফ্রান্সের হয়ে বিশ্বকাপে দারুণ শুরু আনতে দুটি গোল করেন জিরুদ, বাকি দুটি গোল করেছেন আদ্রিয়েন রাবিওত ও কাইলিয়ান এমবাপে।
সবার আগে শেষ ষোলো নিশ্চিত
বিশ্বকাপের আমেজ তখনও খুব একটা জেঁকে বসতে পারেনি। ফ্রান্সের বাদ পড়া নিয়ে তখনও আলোচনা। কিন্তু সব থামিয়ে দিয়ে গ্রুপপর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে জিতে শেষ ষোলো নিশ্চিত করে ফেলে হুগো লরিসের দল। গত কয়েক আসরে ধারাবাহিকভাবে একই দৃশ্য হয়ে থাকা ‘ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের প্রথম রাউন্ডেই বিদায়’ পাল্টে দেয় ফ্রান্স এক ম্যাচ হাতে রেখেই।
গ্রুপপর্বে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে ডেনমার্ককে ২-১ গোলে হারিয়ে প্রথম দল হিসেবে নকআউটে উঠে যায় বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা। কাইলিয়ান এমবাপে করেন জোড়া গোল। গ্রুপ-ডি থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়া ফ্রান্সের তখন পয়েন্ট ৬। শেষ ম্যাচে হারলেও সেটির প্রভাব অবশ্য পড়েনি গ্রুপ টেবিলে।
বেঞ্চের শক্তি, আবার আলোচনা এবং হার
আগেই শেষ ষোলো নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেন কোচ দেশম। তাতে ঘটে হিতে বিপরীত। তিউনিশিয়ার কাছে ১-০ ব্যবধানে হেরে বড় অঘটনে পড়ে রাশিয়া বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন দলটি। গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে শুরুর একাদশে নয়টি পরিবর্তন আনেন ফ্রান্স কোচ। গোড়ালির চোটে বেঞ্চে ছিলেন কাইলিয়ান এমবাপে। অধিনায়ক হুগো লরিসও ছিলেন না।
ম্যাচে ফরাসি বেঞ্চের খেলোয়াড়দের উপর প্রথমার্ধে আধিপত্য দেখায় তিউনিশিয়া। অষ্টম মিনিটেই গোল করে বসে দলটি। লাইন্সম্যান পতাকা তুলে অফসাইডের সংকেত দিলে গোল বাতিল হয়। বিরতির পর ৫৯ মিনিটে ফ্রান্সকে স্তম্ভিত করে লিড আনে তিউনিশিয়া। শেষ পর্যন্ত সেটিই হয়ে ওঠে জয়-পরাজয়ের বাহক।
শকিং হারে বেঞ্চ খেলোয়াড় খেলানোর জন্য চাপে পড়েন ফরাসি কোচ। কেউ কেউ পুরনো সেই কথাও তুলে আনে, ‘ফ্রান্স আর বেশিদূর যাচ্ছে না’। সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় তিউনিশিয়ার বিপক্ষে যোগ করা সময়ের অষ্টম মিনিটে আনা গ্রিজম্যানের গোল। পরাজয় এড়ানোর গোলটি বাতিল হয় ভিএআরে, সেটি নিয়ে ফিফা পর্যন্ত যায় ফ্রান্স। তবে ৬ পয়েন্ট তুলে চ্যাম্পিয়ন হিসেবেই পরের পর্বে আসে, ইতিহাস গড়া জয় পেলেও তিউনিশিয়া ফেরে গ্রুপপর্ব থেকে। ফ্রান্সের সমান ৬ পয়েন্ট থাকলেও গোল ব্যবধানে পিছিয়ে রানার্সআপ হয়ে শেষ ষোলোতে আসে অস্ট্রেলিয়া।
শেষ ষোলোতে এমবাপে ঝলক
কাইলিয়ান এমবাপে যেন সব রেকর্ড ভেঙে দেয়ার মিশনে নেমেছিলেন। নিজেদের চতুর্থ ম্যাচে এসেই পেয়ে যান পঞ্চম গোল। ফ্রান্সের হয়ে একাধিক বিশ্বকাপে চারটি বা তার বেশি করে গোল আগে কেউ করতে পারেননি। শেষ ষোলোর লড়াইয়ে পোল্যান্ডের বিপক্ষে সেই কীর্তিই গড়েছেন ফ্রেঞ্চ স্ট্রাইকার। পোল্যান্ডকে ৩-১ গোলে হারিয়ে শেষ আটের টিকিটও নিশ্চিত করে দিদিয়ের দেশমের দল।
আল সুমামা স্টেডিয়ামে প্রথমার্ধের ৪৪ মিনিটে অলিভিয়ের জিরুদের পর ৭৪ মিনিটে ব্যবধান বাড়ান এমবাপে। ম্যাচের তৃতীয় ও আসরে নিজের পঞ্চম গোলটি আনেন অতিরিক্ত সময়ের প্রথম মিনিটে। যোগ করা সময়ের শেষ মিনিটে রবার্ট লেভান্ডোভস্কির পেনাল্টি গোল শুধু ব্যবধানই কমিয়েছে পোল্যান্ডের হারের। তাতেই বিশ্বকাপে ৯বারের মতো শেষ আটের টিকিট নিশ্চিত করে ফ্রান্স, শেষ চারে ওঠার লড়াইয়ে পড়ে দাপুটে থাকা ইংলিশদের সামনে।
ফেভারিট ইংলিশদের থামিয়ে আরও সামনে ফ্রান্স
সেনেগালকে হারিয়ে শেষ আটে আসা ইংলিশরা দুর্দান্ত ফুটবল দেখিয়েও জিততে পারেনি। কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচটির পেনাল্টি ইস্যুতে বিতর্ক হতে পারে, প্রশ্ন উঠতে পারে রেফারির ভূমিকা নিয়েও। ইংল্যান্ড অধিনায়ক হ্যারি কেনও আক্ষেপ করতে পারেন, সব হিসেব-নিকেশ ছাপিয়ে আল বাইত স্টেডিয়ামে ২-১ গোলে ম্যাচ জিতে নেয় বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স।
ফেভারিট ইংল্যান্ডের বিপক্ষে রোমাঞ্চকর জয়ে সেমি আসা ফ্রান্স শেষ চারে পায় চমক দেখানো আফ্রিকার দল মরক্কোকে। তখন নিশ্চিত সেমির চার দল। নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে আর্জেন্টিনা লড়বে ব্রাজিলকে বিদায় করে দেয়া ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে। তৃতীয় কোয়ার্টারে রোনালদোদের কাঁদিয়ে শেষ চারে ওঠা মরক্কোর বিপক্ষে টানা দ্বিতীয় ফাইনালের টিকিট কাটতে লড়বে এমবাপে-লরিসদের ফ্রান্স।
শেষ চারে মরক্কোর দাপুটে ফুটবল এবং ফ্রান্সের ইতিহাস
ম্যাচের ফল দেখে ঠিকঠাক বিচার করা হয়ত যাবে না, ফ্রান্স-মরক্কোর ফাইনালে ওঠার লড়াইটি তর্ক সাপেক্ষে কাতার বিশ্বকাপেরও সেরা লড়াইয়ের একটি। ফ্রান্সের বিপক্ষে সমানে সমান লড়াই চালিয়েছিল মরক্কো।
এমবাপে-জিরুদদের আক্রমণ সামলে জিয়েচ-আমরাবাতরা ত্রাস ধরিয়ে দিয়েছিল ফরাসি রক্ষণ দুর্গেও। কখনও হুগো লরিস কখনও ফিনিশিংয়ের অভাব, জালের দেখা শুধু মেলেনি।
বিপরীতে, খেলার পাঁচ মিনিটে এগিয়ে যাওয়া ফ্রান্স দ্বিতীয়ার্ধে জালের দেখা পায় আরও একবার। তাতে আর্জেন্টিনার পর ফাইনাল নিশ্চিত করে দিদিয়ের দেশমের দল। আল বাইত স্টেডিয়ামে আফ্রিকার সিংহ খ্যাত মরক্কোর ২-০ গোলে হেরে শেষ হয় বিশ্বকাপ, টানা দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনালের টিকিট কাটে ফ্রান্স।
এবং ফাইনাল…
শিরোপার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকা লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনার সামনে লড়ে টানা দ্বিতীয় ‘সোনালী ট্রফি’ উঁচিয়ে ধরার অপেক্ষায় এমবাপে-গ্রিজম্যানদের ফ্রান্স।