নিখোঁজ হওয়া আর বধ্যভূমিতে মারা যাওয়াই একমাত্র শহীদ বুদ্ধিজীবীর মাপকাঠি হতে পারে না বলে জানিয়েছে সামাজিক সংগঠন প্রজন্মের চেতনা।
বক্তারা বলেন, ২৫ মার্চ ঘাতক হানাদারদের আক্রমণে যারা শহীদ হয়েছেন অথবা যুদ্ধকালীন দেশের নানা স্থানে ঘাতকদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন তারাই আমাদের হৃদয়ে দেশপ্রেমিক শহীদ বুদ্ধিজীবী।
শুক্রবার ৫ আগস্ট বিকেলে রাজধানীর শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেওয়া ব্যক্তি, কলামিষ্ট ও বক্তব্যদানকারী ব্যক্তিদের অপসারণের দাবিতে আয়োজিত মানববন্ধনে বক্তারা এসব কথা বলেন।
প্রজন্মের চেতনার কেন্দ্রীয় কমিটির মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, ১৯৭১ সালের ১১ আগস্ট পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক আদালতে, গোপনে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহি মামলার বিচারকার্য শুরু হয়েছিল। ওই মামলার ১২টি অভিযোগের মধ্যে ৬টিতেই সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল ফাঁসি। সেই মিথ্যা-বানোয়াট মামলার বিরুদ্ধে যখন সমগ্র বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় উঠে ছিল। তখন পাকিস্তানের প্রখ্যাত কবি ফয়েজ আহম্মদ ফয়েজসহ একদল প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী পর্যন্ত প্রকাশ্যে শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করেছিলেন। অথচ ওই বানোয়াট মামলার পক্ষেই কয়েকজন সুযোগসন্ধানী সুবিধাভোগী বিতর্কিত বাঙালি বুদ্ধিজীবী সাক্ষ্য দেয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে! তাদের নামও আছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত তালিকায়।
বক্তারা আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে যারা স্বাধীনতা আন্দোলনসহ জাতির জনকের বিরুদ্ধে কলাম লিখতো এবং বিভিন্ন সভায় বক্তৃতা করত এরকম সুযোগসন্ধানী সুবিধাভোগীদের নামও রয়েছে প্রকাশিত ওই তালিকায়। এমনকি এদেরই একজন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাবধারী। আরেকজন ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলনবিরোধী এক ছাত্রনেতা, যিনি ১৯৫৬ সালে চোরাচালানের দায়ে গ্রেপ্তারও হন। ওই ব্যক্তিই ‘৭১-এ ভারতে গিয়ে বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে এবং অবশেষে পূর্ব পাকিস্তানে পালিয়ে এসে সরকারের আশ্রয়ে থেকে শেখ মুজিব আর মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কাজ করেন। তাই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক এসব বিতর্কিত নিহত ঘাতকদের নাম শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা থেকে অপসারণ করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে।
সংগঠনের আহ্বায়ক মোহাম্মদ গোলাম নবী হোসেন বলেন, ‘এদেশে প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হলেও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রাষ্ট্রীয় কোনো তালিকা ও শহীদ বুদ্ধিজীবীর পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞাও নির্ধারিত ছিল না। তাই ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নে যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করা হয়। এরই অংশ হিসেবে ২০২১ সালের ৭ এপ্রিল প্রথম পর্বে ১৯১ জনের নাম প্রকাশিত হয়। আর দ্বিতীয় পর্বে ১৪৩ জনের তালিকার গেজেট প্রকাশ হয় ১২ জুন ২০২২। এখন পর্যন্ত দুই পর্বে মোট ৩৩৪ জনকে শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে।’
‘কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও ফাঁদে পড়েছে বাংলাদেশ, ফাঁদে পড়েছে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক দুই দফায় প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় বিতর্কিত ব্যক্তিদের নামও স্থান পেয়েছে। তাই আমরা মনে করি, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও বিতর্কিতদের নাম নতুন করে শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় স্থান পাওয়ার বিষয়টি বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জার।’
তিনি বলেন, ‘‘অথচ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নে গঠিত কমিটির ২০২১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সভার কার্যবিবরণীতে উল্লেখ আছে, বিভিন্ন সদস্যের মতের ভিত্তিতে কোনো বিতর্কিত ব্যক্তি অথবা কোনো মহল থেকে বিতর্কিত হওয়ার সুযোগ থাকে এমন ব্যক্তির নাম সুপারিশ করা যাবে না। তাহলে ওই বিতর্কিত ব্যক্তিরা নতুন করে প্রকাশিত শহিদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় স্থান পেলো কি করে? অপ্রিয় হলেও সত্য-ওই বিতর্কিতরা ক্ষমতাশালী বা প্রভাবশালীদের আত্মীয় স্বজন হওয়ায় ১৯৭২ সালেও তালিকাভুক্ত হয়েছে এবং বর্তমানেও ওই বিতর্কিত ব্যক্তিরাই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক দুই দফায় প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় স্থান পেয়েছে।’’
মানববন্ধনে অন্যান্যের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন আহমেদ গেরিলা, সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক এম এম রাশেদ রাব্বি, ঢাকা মহানগর কমিটির আহ্বায়ক শাজাহান কবির সুমন, যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ছালেক-উর-রহমান সুমন, সদস্য হাবিব-উন-নবী নুর।