প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমুদ্রে অভিভাবকত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উপকূলবাসীর প্রকৃত বন্ধু হতে বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের (বিসিজি) প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, এ বাহিনীর মূলমন্ত্র হলো ‘সমুদ্রের অভিভাবক’ যার অর্থ উপকূলবাসীর প্রকৃত বন্ধু হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। সমুদ্রসীমায় বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ মোকাবেলা করে উপকূলের নিরীহ ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্যে কোস্টগার্ড সদস্যদের ব্যাপক প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী।
রোববার রাজধানীর শের-ই-বাংলা নগরে কোস্টগার্ড সদরদপ্তরে বিসিজির ২৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং বিসিজি ডে ২০২৩ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, আমরা চাই আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞানসহ কোস্টগার্ড একটি উন্নত ও শক্তিশালী বাহিনীতে পরিণত হোক। এ লক্ষ্যে সরকার কক্ষপথে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করেছে। এই স্যাটেলাইটের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে কোস্টগার্ডের যোগাযোগ পদ্ধতিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা হয়েছে। আমরা ডিজিটাল পদ্ধতি (স্যাটেলাইটের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন) ব্যবহার করে আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি বলেন প্রধানমন্ত্রী।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং বিসিজির মহাপরিচালক রিয়ার এডমিরাল আশরাফুল হক চৌধুরী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের একটি চৌকস দল প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রীয় সালাম জানায়। এছাড়া কোস্টগার্ডের কর্মকাণ্ড নিয়ে তৈরি করা একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিও তথ্যচিত্রও অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, ৭৫ এর পর জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া কেউই সমুদ্র সীমার অধিকার নিশ্চিত করেনি। আমরা সমুদ্র সীমার অধিকার নিশ্চিত করেছি। এখানকার সম্পদ দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। মিয়ানমার ও ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখেই সমুদ্রসীমার অধিকার অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ১৫ বছরে কোস্টগার্ডের সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। আধুনিক সরঞ্জামে সজ্জিত করার মাধ্যমে কোস্টগার্ডকে ত্রিমাত্রিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা হবে। বিশাল সমুদ্রের সম্পদ আহরণ করা আমাদের দায়িত্ব। এজন্য সুনীল অর্থনীতি ঘোষণা করা হয়েছে। এজন্য আরো গবেষণা দরকার।
তিনি বলেন, প্রাচ্য-পাশ্চাতের মধ্যে সেতুবন্ধন করতে পারে বাংলাদেশ। সেজন্য সমুদ্র উপকূলের নিরাপত্তা বিধান করা একান্তভাবে দরকার। সব বাহিনীকেই আধুনিক স্মার্ট বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, সারাবিশ্বেই অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। মুদ্রাস্ফীতির চাপ পড়েছে বাংলাদেশে। সেজন্য এক কোটি পরিবারকে পারিবারিক কার্ড দেয়া হচ্ছে যাতে স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্ট না হয়। কারো কাছে হাত পেতে নয়, করুণা নিয়ে নয় আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলবে বাংলাদেশ।
এর আগে, সকাল ১০টার দিকে কোস্টগার্ডের সদর দপ্তরে পৌঁছান শেখ হাসিনা। পরে শেরেবাংলা নগরে কোস্টগার্ড সদর দপ্তরে ভি-স্যাটনেট যোগাযোগ ব্যবস্থা, নবনির্মিত পাঁচটি স্টেশন, ১টি আউটপোস্ট উদ্বোধন করেন।
কোস্টগার্ডকে আরও চারটি ওপিভি, গভীর সমুদ্রে টহল দেওয়ার জন্যে নয়টি প্রতিস্থাপনকারী জাহাজ এবং দুটি মেরিটাইম সংস্করণের হেলিকপ্টার নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ সরকার বিভিন্ন ধরনের জাহাজ, অবকাঠামো নির্মাণ ও কোস্টগার্ডের আঞ্চলিক কার্যালয় নির্মাণের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় কোস্টগার্ডের কার্যক্রম সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়।
তিনি আরও বলেন, ২০০৯ সালের পর দেশের বিভিন্ন উপকূলীয় ও প্রত্যন্ত এলাকায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র, কর্মকর্তা ও নাবিকদের জন্য ঘাঁটি, অফিসার্স ম্যাচ, নাবিকদের কোয়ার্টার, প্রশাসনিক অবকাঠামো ও কোস্টগার্ড কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পটুয়াখালী অঞ্চলে “বিসিজি বেইজ অগ্রযাত্রা” নিজস্ব প্রশিক্ষণ ঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে কোস্টগার্ড সদস্যদের প্রশিক্ষণ সক্ষমতা জোরদার করতে সব ধরনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, কোস্টগার্ডদের বিভিন্ন জাহাজ নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়ায় একটি ডকইয়ার্ডও নির্মাণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার কোস্টগার্ডকে ধারাবাহিকভাবে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০৩০ ও ২০৪০ সালের মধ্যে এ বাহিনীর দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে সুনীল অর্থনীতি ও গভীর সমুদ্রে নিরাপত্তা রক্ষায় প্রয়োজনীয় জাহাজ সংগ্রহ ও কোস্টগার্ড সদস্যদের সরঞ্জাম আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু সমুদ্র সম্পদ ও সমুদ্রে দেশবাসীর আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘দি টেরিটরিয়াল ওয়াটারস এবং মেরিটাইম জোন অ্যাক্ট’ ১৯৭৪ আইন প্রণয়ন করেন। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই প্রথম এ আইন প্রণয়ন করে।
জাতিসংঘ ১৯৮২ সালে এ ধরনের আইন প্রণয়নের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতিসংঘ এটিকে আইনে পরিণত না করা পর্যন্ত শুধু এ অঞ্চলে নয় ইউরোপ এবং বিশ্বের অন্যান্য স্থানেও বঙ্গবন্ধুর প্রণীত আইন অনুসরণ করে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি করে।
শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার বন্ধুপ্রতিম সম্পর্ক বজায় রেখে প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে সমুদ্রে দেশের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে।
তিনি ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ এ পরিণত করতে তার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ কাজের জন্য কোস্ট গার্ডের কর্মকর্তা, নাবিক ও অসামরিক ব্যক্তিদের পদক দেবেন প্রধানমন্ত্রী। এবার ১০ জন করে পাচ্ছেন বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড পদক, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড (সেবা) পদক, প্রেসিডেন্ট কোস্ট গার্ড পদক এবং প্রেসিডেন্ট কোস্ট গার্ড (সেবা) পদক।