সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কয়েকদিন আগে একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। আজারবাইজানের বাকুতে চলতি ফিদে দাবা বিশ্বকাপে দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে সেমিফাইনালে ওঠার পর গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ। সাংবাদিক বুম হাতে যখন ১৮ বর্ষী তরুণ দাবাড়ুর সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন, পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রজ্ঞানন্দের মা। আবেগ মাখানো হাসিমুখে গর্বিত গৃহিণী মায়ের সেই চাহনির ছবি সকলের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। সন্তানের অবিস্মরণীয় সাফল্যে চেয়ারে বসে নাগলক্ষ্মীর আনন্দঅশ্রু শাড়ির আঁচলে মোছার ছবিটিও সবাইকে আবেগাপ্লুত করেছে।
তামিলনাড়ু রাজ্যের চেন্নাইতে জন্ম প্রজ্ঞানন্দের। ভারতকে আবারও আনন্দের জোয়ারে ভাসিয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। বিশ্বনাথন আনন্দের পর দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে দাবা বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠে বনে গেছেন রত্ন। সোমবার সেমিতে বিশ্বের তিন নম্বর দাবাড়ু ফ্যাবিয়ানো ক্যারুয়ানাকে টাইব্রেকারে ৩.৫-২.৫ ব্যবধানে হারান দাবার বিস্ময় প্রতিভার অধিকারী তরুণ।
প্রজ্ঞানন্দের বাবা রমেশ বাবু স্টেট কর্পোরেশন ব্যাংকে কর্মরত। গৃহিণী মাকে সত্যিকারের রত্নগর্ভা বলা যায়। কারণ তার বড় সন্তান রমেশবাবু বৈশালী দাবায় একজন আন্তর্জাতিক মাস্টার ও নারী গ্র্যান্ডমাস্টার। বড় বোনের দাবা খেলা দেখে তাতে মজে গিয়েছিলেন প্রজ্ঞা। ফলাফল তো সামনেই।
বৈশালীর টিভি দেখার নেশা ছাড়াতে বাবা স্থানীয় দাবার অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দেন। বড় বোনের দেখাদেখি প্রজ্ঞানন্দও দাবায় মজে যান। ৬৪ খোপের খেলা হয়ে ওঠে তার নেশা। ছেলেকেও পরে দাবার অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করেন রমেশবাবু। সেই ছেলে ভারতের দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলবেন।
মাত্র ১০ বছর বয়সে প্রজ্ঞানন্দ ২০১৬ সালে হয়েছিলেন ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ আন্তর্জাতিক মাস্টার। ১৬ বছর বয়সে তৎকালীন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেনকে পরাজিত করে সাড়া ফেলেন। ২০১৩ সালে বিশ্ব যুব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ অনূর্ধ্ব-৮ আসরে শিরোপা জয়ের মধ্য দিয়ে প্রজ্ঞানন্দ শুরু করেন ক্যারিয়ার, পেয়ে যান ফিদে মাস্টার খেতাব। পরে ২০১৫ সালে অনূর্ধ্ব-১০ আসরের শিরোপাও জিতেছিলেন।
২০১৭ সালের নভেম্বরে বিশ্ব জুনিয়র দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে প্রজ্ঞানন্দ প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নর্ম অর্জন করেন। পরের বছর এপ্রিলে গ্রিসে হেরাক্লিয়ন ফিশার মেমোরিয়াল জিএম নর্ম টুর্নামেন্টে পেয়ে যান দ্বিতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার নর্ম। ইতালিতে ২০১৮ সালে জুনে তৃতীয় ও চতুর্থ নর্ম অর্জন করেন। মাত্র ১২ বছর ১০ মাস ১৩ দিন বয়সে হয়ে যান আন্তর্জাতিক গ্র্যান্ডমাস্টার। অভিমন্যু মিশ্র, সের্গেই কার্জাকিন, গুকেশ ডি, জাভোখির সিন্দারভের পরে গ্র্যান্ডমাস্টার (জিএম) খেতাব অর্জনকারী পঞ্চম কনিষ্ঠ দাবাড়ু প্রজ্ঞানন্দ।
তৃতীয় ভারতীয় দাবাড়ু হিসেবে (আনন্দ এবং হরিকৃষ্ণের পর) ২০২০ সালে অনলাইন এয়ারথিংস মাস্টার্স র্যাপিড টুর্নামেন্টে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেনের বিপক্ষে জয় পান। চেসেবল মাস্টার্স অনলাইন র্যাপিড দাবা টুর্নামেন্টে ২০২২ সালে তিনি নরওয়ের গ্র্যান্ডমাস্টার ম্যাগনাস কার্লসেনকে আবার পরাজিত করেন।
একের পর এক আসরে অংশ নিয়ে সাফল্যের মুকুটে একের পর এক পালক যুক্ত করতে থাকা প্রজ্ঞানন্দ এবার গড়লেন নতুন ইতিহাস। ভারতের সর্বকনিষ্ঠ দাবাড়ু হিসেবে হয়েছেন বিশ্বকাপের ফাইনালিস্ট। কাকতালীয়ভাবে ফাইনালেও তার প্রতিপক্ষ কার্লসেন।
বিশ্বকাপ দাবায় ফাইনাল নিশ্চিতের পর প্রজ্ঞানন্দকে অভিনন্দন জানান গ্র্যান্ডমাস্টার বিশ্বনাথন আনন্দ। টুইটারে লিখেছেন, ‘প্রজ্ঞা ফাইনালে গিয়েছে। সে ফ্যাবিয়ানো ক্যারুয়ানাকে হারিয়ে এখন ম্যাগনাস কার্লসেনের মুখোমুখি হবে। কী অসাধারণ পারফরম্যান্স!’