এম এম মাহবুব হাসান: অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান বিপিএম (বার), পিপিএম (বার)। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)’র ৩৬তম পুলিশ কমিশনার হিসেবে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। জনবান্ধব, আধুনিক ও পজিটিভ পুলিশিংয়ের রোল মডেল হিসেবে যার জুড়ি মেলা ভার। ট্যুরিস্ট পুলিশ প্রধানের পদ থেকে ব্যস্ততম ও জনবহুল ঢাকা মহানগরীর পুলিশ কমিশনার হিসেবে তার আবির্ভাবকে কেন্দ্র করে জনমনে খুশির জোয়ার বইছে।
হাবিবুর রহমান এমনি একজন পুলিশ কর্মকর্তা, যিনি তার মেধা, প্রজ্ঞা, যোগ্যতা, কর্মনিষ্ঠা ও সততার গুনে পৌঁছে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। পুলিশ বিভাগে ধারাবাহিক সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ এ পর্যন্ত তিনি তিনবার বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) ও দুইবার রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম) পেয়েছেন। এছাড়া তিনি দুইবার সাফল্যের সহিত বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন কর্মঠ ও নিবেদিত উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার বাইরে তিনি একজন সফল ক্রীড়া সংগঠক, লেখক, গবেষক, সমাজ সংস্কারক, সমাজসেবক এবং বাংলাদেশ পুলিশ প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা ‘ডিটেকটিভ’ এর সম্পাদকও। তার চেয়েও বড় কথা বহুমাত্রিক প্রতিভাসম্পন্ন হাবিবুর রহমানের বড়গুণ তিনি একজন আদর্শ ও মানবিক ব্যক্তিত্ব যা তাকে সবকিছু থেকে এগিয়ে রেখেছে।
হাবিবুর রহমান ছাত্রজীবনে পড়াশুনার পাশাপাশি সাংবাদিকতা করতেন, কিন্তু সেটা নিজের জন্য নয় সেটি ছিল সমাজের উন্নয়নের জন্য। তার ছোট ছোট প্রতিবেদনে স্থান পেত সমাজের বিভিন্ন জরাজীর্ণতা ও সাধারণ মানুষের কষ্টগুলো। সাংবাদিকতার পেশা থেকে তিনি কোনদিন কোনো সুবিধা নেননি। তিনি শিখেছেন কোন পরিবর্তন করতে হলে কোন বিনিময় দিয়ে নয় বরং নিজের সবটুকু নিংড়ে দিয়ে করতে হয় । বলা যায় এই সাংবাদিকতা পেশা থেকেই হাবিবুর রহমানের লেখালেখির হাতে খড়ি এবং এই অনন্য গুণটি পেশাগত জীবনে তাকে দিন দিন উচ্চতর স্থানে প্রতিষ্ঠিত করছে।
হাবিবুর রহমান ১৭তম বিসিএস ক্যাডার হিসেবে উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ পুলিশে সহকারি পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান করেন। সারদাতে পুলিশিং প্রশিক্ষণকালে সকল সহকর্মীদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। নিজের নেতৃত্ব ও সৃজনশীলতা দিয়ে প্রশিক্ষণ স্যুভেনির ‘আমার হলো শুরু’র সম্পাদক নির্বাচিত হন যেখানে নিজের গবেষণালব্দ লেখনিতে স্থান পায় বাংলাদেশ পুলিশের শেকড়সন্ধানী ইতিহাস, ঐতিহ্য ও করণীয় নির্ধারণ সম্পর্কিত নানান দিক। সাংবাদিকতার পর পুলিশ হিসেবে সেই যে লেখালেখি শুরু করলেন এরপর আর কখনো পিছু হটেননি। পুলিশে ঐহিত্যবাহী মাসিক ম্যাগাজিন ‘ডিটেকটিভ’ এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক পরে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে এটির গুনগত, ভাষাগত ও প্রকাশনাগত আমূল পরিবর্তন এনে ডিটেকটিভকে পুরো পুলিশ বাহিনীর জন্য একটি সমৃদ্ধ মুখপত্র হিসেবে পাঠকের সামনে হাজির করেছেন তিনি।
২০০৯ সালে ডিএমপি’র উপপুলিশ কমিশনার (সদর দপ্তর) পদে থাকাকালীন তিনি ‘মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ’ নামে একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেন যার মাধ্যমে সর্বপ্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধে পুলিশের অগ্রণী ভূমিকা প্রকাশ্যে আসে বেশ বড় পরিসরে। একই সময়ে রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে ২০১০ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠা করেন ‘পুলিশ ব্ল্যাড ব্যাংক’ যা দেশের যে কোন আধুনিক প্রাইভেট ব্ল্যাড ব্যাংকের মতোই উন্নত সেবাদানো সক্ষম। পুলিশ ব্ল্যাড ব্যাংক’ বর্তমান শুধু পুলিশ সদস্যদেরই রক্ত সরবরাহ করে না, যে কোন প্রয়োজনে অসহায় ও মুমূর্ষু রুগীর পাশে দাঁড়াচ্ছে। পুলিশ ব্ল্যাড ব্যাংকের পথযাত্রা ছিলো হাবিবুর রহমান এর অনন্য অবদান।
২০১২ সালে হাবিবুর রহমান ঐতিহ্যবাহী ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি ঢাকা জেলার সার্বিক আইন-শৃংঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অভিনব সব কলা-কৌশল অবলম্বন করে ব্যাপক প্রশংসিত হন। এ সময় মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর ইতিহাস ঐতিহ্যকে সমগ্র জাতির সম্মূখে চিরস্মরণীয় কর রাখতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অবস্থিত টেলিকম ভবনের পাশে ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর’ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ২০১৩ সালে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং ২০১৭ সালের জাতীয় পুলিশ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটির আনুষ্ঠানিক শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন। জাদুঘরটিতে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত রাইফেল, বন্দুক, মর্টার শেল, হাতব্যাগ, টুপি, চশমা, মানিব্যাগ, ইউনিফর্ম, বেল্ট, টাই, স্টিক, ডায়েরি, বই, পরিচয়পত্র, কলম, মেডেল, বাঁশি, মাফলার, জায়নামাজ, খাবারের প্লেট, পানির মগ, পানির গ্লাস, রেডিও, শার্ট, প্যান্ট, র্যাংক ব্যাজসহ টিউনিক সেট, ক্যামেরা, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, লোহার হেলমেট, হ্যান্ড মাইক, রক্তভেজা প্যান্ট-শার্ট, দেয়ালঘড়ি, এমএম রাইফেলসহ অনেক কিছু সংরক্ষণ আছে।
‘মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ’ গ্রন্থ সম্পদনা করে হাবিবুর রহমান কাগজে-কলমে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকাকে ইতিহাসে স্থান করে দেওয়ার জন্য অবদান রাখেন আর ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর’ প্রতিষ্ঠা করে পুলিশের সেইসব অকুতোভয় অবদানসমূহকে প্রমাণ সাপেক্ষে বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই বিরল কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে হাবিবুর রহমান-এর নাম উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার থাকাকালীন তিনি সাভারে বসবাসরত ২০ হাজারেরও বেশি বেদে জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনমান উন্নয়নের লক্ষে বিভিন্ন কর্মমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বেদে জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনমান উন্নয়নের লক্ষে প্রাথমিকভাবে ১০৫ জন বেদে নারীকে সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে পোড়াবাড়িতে কর্মসংস্থানের জন্য মিনি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। সাপ খেলা দেখানোর পেশা থেকে ফিরিয়ে এনে ৩৫জন বেদে যুবককে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রত্যেকের জন্য চাকুরির ব্যবস্থা করা, কোচিং সেন্টার ও কম্পিউটার সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে বেদে ছেলে-মেয়েদের পড়া লেখার অতিরিক্ত সুযোগ তৈরি করা, সরকারি সহযোগিতায় ১৮টি জরাজীর্ণ রাস্তা মেরামত করা, একটি মসজিদ নির্মাণ করা এবং স্থানীয় বেদে জনসাধারণের জন্য একটি পাকা ইদগাহ নির্মাণ করাসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করেন।
তিনি উত্তরণ ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন যার মাধ্যমে সাভারের বেদে পল্লীর বাসিন্দাদের জন্য প্রায় ৩০০টি ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। সাভারের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মুন্সীগন্জের বেদে শিশুদের জন্যও গড়ে তোলা হয়েছে স্কুল ও কম্পিউটার সেন্টার। গত বছর মুন্সীগঞ্জের ১৯টি বেদে পরিবারের জন্য ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে, যার ফলে তাদের মনে এখন স্বস্তির হাওয়া। বর্তমানে ঢাকা ও মুন্সীগঞ্জ ছাড়াও গাজীপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নাটোরের সিংড়া এলাকার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষদের নিয়ে বিভিন্ন প্রয়োজনমূখী কাজ করছে এ প্রতিষ্ঠানটি। তাছাড়া, ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জের বেঁদেদের জন্য ৫৯ টি ঘর নির্মাণ করে হাসি ফুটিয়েছে ভাসমান মানুষের মুখে। বলতে গেলে সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় ৩৬ লাখ বেদে ও মান্তা সম্প্রদায়ের কাছে তিনি যেমন হয়ে উঠেছেন আশার বাতিঘর তেমনি তিনি এই জনগোষ্ঠীর সাড়ে চারশো বছরের অস্পৃশ্য ও গ্লানিময় জীবনের মুক্তিদূতও।
বেদে জনগোষ্ঠীদের উন্নয়নে কাজ করতে গিয়ে তিনি প্রত্যক্ষ করেন তারা নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় একটি আলাদা ভাষা ব্যবহার করেন। বেশ কিছুদিন যাবৎ এটি প্রত্যক্ষ করতে থাকেন এবং এই দুর্বোধ্য ভাষাটির প্রতি কৌতুহলী হন। তিনি বেদে জনগোষ্ঠীর মধ্যে থেকে পরিচিত কয়েকজনকে ডেকে জানতে পারলেন যে এটি বেদে জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা যার নাম ‘ঠার’। তিনি ভাষাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চেষ্টা করেন এবং বেশকিছু শব্দ ও বাক্য নিজের নোট বুকে লিখে রাখেন। এরপর খোঁজ করতে থাকেন এই ভাষাটি আসলে কীভাবে এলো, কারা ব্যবহার করছে এবং বাংলাদেশের কোন কোন প্রান্তে এই ভাষাটি ব্যবহৃত হচ্ছে। পাশাপাশি তিনি এটি নিয়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। তিনি উপলব্ধি করলেন যে ‘ঠার’ ভাষাটি বাংলাদেশের বিলুপ্তপ্রায় ভাষাগুলোর মধ্যে একটি এবং এই ভাষাটি সংগ্রহ বা সংরক্ষণে তেমন কোন কাজও হয়নি।
তিনি আরও জানতে পারলেন যে এই ভাষাটির আসলে কোন লেখ্য রূপ নেই এবং এটি একটি কথ্য ভাষা। তাই বলে সাড়ে চারশো বছর যাবৎ বসবাস করে আসা একটি জনগোষ্ঠীর ভাষাটি অযত্নে বা অবহেলায় এভাবে হারিয়ে যাবে এই ভাবনা তাকে সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াতে থাকে। তিনি বিভিন্নভাবে ভাষাটি সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট অনেকের মাধ্যমে চেষ্টা করে দেখলেন যে আসলে যথাযথ তথ্য-উপাত্তের অভাবে কেউই এটির গভীরে প্রবেশ করতে পারছেন না। ফলে নিজেই শুরু করলেন বিস্তর গবেষণা। ভাষা বিজ্ঞানের উপর দক্ষতা না থাকায় প্রথমে তাকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রফেসরের নিকট কিছুদিন প্রাইভেটও পড়েছেন যার ফলে ভাষা বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রপ্ত করতে সক্ষম হন তিনি। বিলুপ্তপ্রায় ঠার ভাষাটির আদ্যপান্ত উদ্ধার করে এটির পুনর্গঠন, পঠন ও ব্যবহারিক রূপ দিতে প্রায় আট বছর সময় লেগে যায়। এই আট বছরের ব্যবধানে কর্মজীবনে হাবিবুর রহমান ঢাকা পুলিশ সুপার থেকে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ হেড কোয়াটার্সের অতিরিক্ত ডিআইজি (পারসোনাল ম্যানেজমেন্ট -১) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, পরবর্তীতে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ হেড কোয়াটার্সের ডিআইজি (অ্যাডমিন) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমান পদে আসীন হবার আগে ২০১৯ সালের ১৬ মে থেকে তিনি ঢাকার রেঞ্জ ডিআইজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঢাকা রেঞ্জের ১৩টি জেলার সার্বিক আইন-শৃংঙ্খলা পরিস্তিতি নিয়ন্ত্রণের কাজটি পুলিশ হেড কোয়াটার্সের এক বিজ্ঞপ্তি মারফত রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়।
অবশেষে গবেষণাগ্রন্থ ‘ঠার
বেঁদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ নামক এই অসাধ্য সাধনের কাজটি শেষ করেন বিশিষ্ট গবেষক ও ঋদ্ধ লেখক বাংলাদেশ পুলিশের তৎকালীন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান। গত ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ (মঙ্গলবার) বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে দেশবরেণ্য গুণীজনদের উপস্থিতিতে এক জনাকীর্ণ অনুষ্ঠানে বইটির মোড়ক উন্মোচিত হয়। বাংলা ভাষায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে হাবিবুর রহমানই প্রথম এমন কোন গবেষণাগ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্রন্থটির প্রকাশক পাঞ্জেরী পাবলিকেশন আয়োজিত মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম।
দীর্ঘ ৮ বছরের নিরন্তর গবেষণার ফসল বেদে জনগোষ্ঠীর বিলুপ্তপ্রায় ভাষা ‘ঠার’ নিয়ে এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হবার পর থেকেই দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। এরই ফলশ্রুতিতে এই গ্রন্থটি মাতৃভাষা সুরক্ষা, উন্নয়ন ও পুনরুজ্জীবনে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৩ সালের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা জাতীয় পদকে ভূষিত হন হাবিবুর রহমান। গত ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের অডিটরিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বইটির লেখক হাবিবুর রহমানকে এই বিরল সম্মাননা পদক তুলে দেন। ‘ঠার : বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ গ্রন্থটি রচনার জন্য এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করার স্বীকৃতিস্বরূপ গত ২ মে ২০২৩ মালয়েশিতে ‘জো জো ইন্টারন্যাশনাল আইকোনিক স্টার অ্যাওয়ার্ড-২০২৩’ পদকে ভুষিত হয়েছেন হাবিবুর রহমান যেটি তার ব্যক্তি জীবন, কর্ম জীবন ও দেশের জন্য অত্যন্ত গর্বের।
শুধু বেদে জনগোষ্ঠী নয় হাবিবুর রহমান সমাজের পিছিয়ে পড়া হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে নানামূখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তাদের জন্য বিউটি পার্লার, মিনি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, গরুর খামার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনসহ ফুড ভ্যানের মাধ্যমে অনেকেই স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলেছেন। সম্প্রতি বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ীদের মাঝে এই স্বাবলম্বী হওয়া হিজড়াদের পক্ষ থেকে ২২ লক্ষ টাকা অনুদানের বিষয়টি অসংখ্য মানুষের হৃদয় ছুয়ে গেছে। বেদে জনগোষ্ঠী ও তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের কল্যাণ ছাড়াও রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ার ১৩৪০জন যৌনকর্মীর পাশে দাঁড়িয়েছে তিনি। পল্লীর বাসিন্দাদের গর্ভে জন্ম নেওয়া পিতৃপরিচয়হীন সন্তানদের জন্য শিক্ষা উপকরণ বিতরণের পাশাপাশি তাদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছেন হাবিবুর রহমান। করোনাকালীণ প্রথম কোন মৃত যৌনকর্মীকে ইসলামিক শরীয়া মোতাবেক দাফনকার্য সম্পাদন করে এবং প্রথম কোন যৌনকর্মীর কুলখানির আয়োজন করে তিনি সর্বমহলের প্রসংশা কুড়িয়েছিলেন। ইতিপূর্বে যৌনকর্মীরা মারা গেলে রাতের অন্ধকারে বা সকলের অগচরে মৃতদেহকে পদ্মা নদীর চরে বালুর মধ্যে গুঁজে রাখা হতো বা ইট-বালু ভর্তি বস্তা বেধে দিয়ে লাশ পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হতো। হাবিবুর রহমানের উদ্যোগে যৌন পল্লীর বাসিন্দাদের জন্য বর্তমানে একটি স্থায়ী কবরস্থান তৈরি করা হয়েছে। অনেক যৌনকর্মী ইতিমধ্যে নিজের পেশা বদল করে স্বাবলম্বী হতে শুরু করেছে। তিনি যৌনকর্মী ও তাদের কোলে জন্ম নেওয়া পিতৃ পরিচয়হীন সন্তানদের সামাজিক পরিচয় রক্ষার জন্য দৌলতদিয়া পতিতা পল্লীর নাম পরিবর্তন করে ‘দৌলতদিয়া বাজার পূর্বপাড়া’ নাম রেখেছেন।
যৌনকর্মীদের মানবাধিকার ও সামাজিক মর্যাদা রক্ষায় হাবিবুর রহমানের এই বিরল কর্মকান্ডগুলো তুলে ধরা হয়েছে পুলিশ পরিদর্শক মোঃ জাহিদুর রহমানের রচনা ও নির্দেশনায় উপস্থাপিত ‘অচলায়তনের অপ্সরী’ মঞ্চ নাটকে। ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি’র দায়িত্ব থাকাকালীন হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঢাকার কেরানিগঞ্জে গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র (ওয়েসিস)। ওয়েসিস খুব অল্প সময়ের মধ্যেই একটি শক্তপোক্ত প্রাতিষ্ঠানির কাঠামোর উপর দাড়িয়ে প্রায় ২০০ জন রুগীকে সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে সহায়তা করেছে।
ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন হাবিবুর রহমান। তিনি ক্রীড়াঙ্গনে থিতিয়ে যাওয়া জাতীয় খেলা কাবাডিকে মূলধারায় তুলে এনেছেন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সুনাম কুড়িয়ে চলেছেন। ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে এখন তিনি বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক, এশিয়ান কাবাডি ফেডারেশনের সহসভাপতি এবং আন্তর্জাতিক কাবাডি ফেডারেশনের সহসভাপতির দায়িত্বও সামলাচ্ছেন কার্যকরভাবে ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারের নির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনাটি নিয়ে বেশ কয়েক বছর গবেষণা করেন হাবিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার পুর্নাঙ্গ রায় অ্যানালাইসিস করে নির্মম সত্য ঘটনাটিকে সমগ্র জাতির কাছে তুলে ধরতে সচেষ্ট হন তিনি। অবশেষে এই জঘণ্য হত্যাযজ্ঞের পূর্ণাঙ্গ ঘটনার উপর ‘অভিশপ্ত আগস্ট’ নামে একটি মঞ্চনাটক তৈরি করেন যা এক বছরেই ১০০ বারেরও বেশি মঞ্চস্থ হয়েছে, এমনকি এটি এখন বিশ্ব রেকর্ড করতে চলেছে। কারণ, ইতিহাসে আর কোন মঞ্চনাটক এক বছরে ১০০ বারের বেশি মঞ্চস্থ হয়নি। এছাড়া তিনি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক কিছু ছবি ও ছবির অন্তরালের গল্প নিয়ে ‘পিতা তুমি বাংলাদেশ’ নামে একটি ফটো অ্যালবাম প্রকাশ করেন।অন্যদিকে পুলিশকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন উক্তি ও বক্তব্য নিয়ে ‘বঙ্গবন্ধুর কথা ও কলমে পুলিশ’ শিরোণামে প্রকাশনাধীন একটি বইয়ের সংকলন ও সম্পাদনা করছেন তিনি। যার ভূমিকা লিখেছেন স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
উল্লেখ্য, গত ৩ জানুয়ারি ২০২৩, রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পুলিশ সপ্তাহ-২০২৩- এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর লিখিত পত্রাবলী নিয়ে হাবিবুর রহমান সম্পাদিত ‘চিঠিপত্রঃ শেখ মুজিবুর রহমান’ এবং এর ইংরেজী সংস্করণ ‘Letters of Sheikh Mujibur Rahman’ শীর্ষক দু’টি গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুটি বইতেই কো-এডিটর হিসেবে কাজ করেছেন তারই সহকর্মী অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ এনায়েত করিম ।
গোপালগঞ্জের পবিত্র ও উর্বর মাঠি ফুড়ে জন্ম নেওযা হাবিবুর রহমান এই দেশের ১৮ কোটি মানুষের অতি ক্ষুদ্রাংশের বৃহত্তর সমস্যাগুলো নিয়ে নিরন্তর লড়ে যাচ্ছেন- যে সমস্যাগুলোও ঠিক মানুষের তৈরি। হাবিবুর রহমান এই ধরিত্রীর একজন সুর্য সন্তান হিসেবে বাংলাদেশের মনুষ্যসৃষ্ট চলমান বৈষম্যগুলো দূর করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় সফল হবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ, ব্যক্তি ও কর্মজীবনে হাবিবুর রহমান নিজের পুরোটাই সপে দিয়েছেন দেশের কল্যাণে, দেশের মানুষের কল্যাণে।
দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ তথা বাংলাদেশ পুলিশের রোল মডেল ডিএমপি’র ৩৬তম পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান সত্যিকারের একজন মানবতার ফেরিওয়ালা- যার তুলনা হয় না।