পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফ আজ ৭৯ বছর বয়সে দুবাইয়ের একটি হাসপাতালে মারা গেছেন। রাজনৈতিক ও পেশাগত নানা কারণে তিনি ছিলেন আলোচিত ও বিতর্কিত।
১৯৯৯ সালের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর অসংখ্য হত্যা প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে যান পারভেজ মোশাররফ। ২০০৮ সালে তার কর্মজীবনে তিনি পরাজয়ের সম্মুখীন হয়ে অফিস ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। এদিকে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ হয় অপমানিত হয়ে গ্রেপ্তার হবার মধ্যে দিয়ে ।
২০২২ সালের জুনে, দুবাইয়ে পারভেজ মোশাররফের মৃত্যু হয়েছে এমন মিথ্যা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পরে তার পরিবার ঘোষণা করে, তিনি অ্যামাইলয়েডোসিস নামক একটি বিরল রোগের সাথে যুদ্ধ করছেন যা থেকে সুস্থ হবার সম্ভাবনা খুব কম।
সংক্ষিপ্ত আকারে তার বৈচিত্র্যময় জীবনের খণ্ড চিত্র তুলে ধরা হল:
রাজনীতিতে আসার আগে
পারভেজ মোশাররফ ১৯৪৩ সালের ১১ আগস্ট অবিভক্ত ভারতের দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন। ব্রিটিশ শাসন অবসানের ফলে ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর তার পরিবার অন্যান্য লক্ষাধিক মুসলমানদের সাথে নবনির্মিত পাকিস্তানে চলে আসে।
১৯৬১ সালে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে প্রবেশের আগে তিনি করাচির সেন্ট প্যাট্রিক হাই স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা এবং লাহোরের ফরমান ক্রিশ্চিয়ান কলেজে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন।
তিনি ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে এবং পাঁচ বছর পরে ১৯৭০ সালের দ্বিতীয় সংঘর্ষে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন, সেই সময় তিনি একজন কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন।
১৯৯৮ সালে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল জাহাঙ্গীর কারামত পদত্যাগের পর পারভেজ মোশাররফ সেনাবাহিনির শীর্ষ পদে উন্নীত হন।
১৯৯৯ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শরীফ মোশাররফকে তার পদ থেকে বরখাস্ত করার চেষ্টা করেন তিনি, কিন্তু সিনিয়র সেনা কর্মকর্তারা সেসময় তার এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছিলেন।
সেই সময় দেশের বাইরে থাকা পারভেজ মোশাররফ দ্রুত পাকিস্তানে ফিরে আসেন এবং রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে প্রধান নির্বাহীর পদ গ্রহণ করেন।
ক্ষমতা গ্রহণ
পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রফিক তারার এসময় তার পদে বহাল ছিলেন। দুই বছর পর ২০০১ সালের জুনে পারভেজ মোশাররফ আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেকে তার স্থলাভিষিক্ত করে রাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণ করেন।
২০০১ সালের জুলাই মাসে একটি শীর্ষ সম্মেলনের জন্য তিনি ভারত সফর করেন, তখন তিনি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর সাথে আলোচনা করেন এবং দিল্লীতে তার পরিবারের পৈতৃক বাড়ি পরিদর্শন করে সেখানে ছবি তোলেন। ফলে দুই দেশের সম্পর্কের উন্নতি নিয়ে আশার সঞ্চার ঘটে।
কিন্তু কাশ্মীর নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলমান বিরোধ ও অচলাবস্থার কারণে সেই আশা ক্ষীণ হয়ে যায়। ভারত মোশাররফকে ১৯৯৯ সালের কার্গিলে সংঘাতের স্থপতি হিসাবে বিবেচনা করে। একই বছর আফগানিস্তানে ভারতীয় এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে জড়িত বলে সন্দেহ করে ভারত।
ফলে তার ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
ক্ষমতা গ্রহনের পর চ্যালেঞ্জ
২০০১ সালে ১১ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টুইনটাওয়ারে ইসলামপন্থী জঙ্গিদের হামলার পর পাকিস্তানের নেতা হিসাবে মোশাররফকে বেশ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের তার প্রতি বার্তাটি ছিল, “আপনি হয় আমাদের সাথে না হয় আমাদের বিরুদ্ধে।”
তাই মোশাররফ পাকিস্তানী নীতিতে একটি বিতর্কিত ইউ-টার্ন নিয়েছিলেন। তিনি প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানে তালেবান সরকারকে উৎখাত করার জন্য আমেরিকান নেতৃত্বাধীন সামরিক অভিযানকে সমর্থন করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিত্রতা বজায় রাখার জন্য।
২০০২ সালের জানুয়ারিতে, তিনি পাকিস্তানে ইসলামি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি মসজিদ ও ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্রের সকল বিদেশী অর্থায়ন নিষিদ্ধ করেন এবং ইসলামিক শিক্ষার জন্য পাকিস্তানে আসা বিদেশী ছাত্রদের সংখ্যা কমিয়ে আনেন।
২০০২ সালের অক্টোবরে, একটি মোশাররফপন্থী জোট সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদীয় আসনে জয়লাভ করে, যদিও বিরোধীরা কার্যকরভাবে ১২ মাসেরও বেশি সময় ধরে জাতীয় পরিষদের সকল কার্যক্রমকে বাধা প্রদান করে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পতন থেকে ঘুরে দাঁড়ানো প্রেসিডেন্ট মোশাররফের ক্ষমতা গ্রহণের প্রতিশ্রুতির অংশ ছিল এবং তার সংস্কারগুলি সাধারণত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি দ্বারা প্রশংসিত হয়েছিল।
২০০৫ সালের অক্টোবরে একটি বিশাল ভূমিকম্প পাকিস্তানের কাশ্মীরে আঘাত হানে এতে ৭৩,০০০ এরও বেশি মানুষ মারা যায় এবং ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। সেসময় মশাররফকে একটি মানবিক ট্র্যাজেডির সাথে লড়ায় করতে হয়েছিল।
২০০৭ সালে প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মুহাম্মদ চৌধুরীকে দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু দেশের আইনজীবীদের একটি বিশাল অংশের বিক্ষোভ দেখে সুপ্রিম কোর্ট শেষ পর্যন্ত প্রধান বিচারপতিকে পুনর্বহাল করে এবং অসদাচরণের সমস্ত অভিযোগ খারিজ করে। এই ঘটনার পর তার সরকারের উপর চাপ বেড়ে যায়।
২০০৭ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ইসলামাবাদের লাল মসজিদ অবরোধ করে, যার ফলে তিনি ধর্মীয় নেতা এবং ছাত্রদের নিন্দার মুখে পড়েন।
সেসময় ছাত্ররা অস্ত্র হাতে কয়েকদিন ধরে সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করে।নভেম্বরে মোশাররফ জরুরি অবস্থা জারি করেন।
এই জরুরী অবস্থা জারি করার ফলে তিনি বিরোধী দল ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের তোপের মুখে পড়েন এবং ফলে তার জনপ্রিয়তা তলিয়ে যায়।
ক্ষমতার পতন
২০০৭ সালের ডিসেম্বরে একজন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীর দ্বারা মর্মান্তিক ভাবে নিহত হন পাকিস্তানের আরেক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো। বেনজির ভুট্টোর অনুসারীরা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য পারভেজ মোশাররফকে দায়ি করে।
২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট মোশাররফ একটি দীর্ঘ বক্তৃতার মাধ্যমে তার পদত্যাগের ঘোষণা দেন। এবং দেশত্যাগ করে অবসরে যান।
২০১৩ সালের মার্চ মাসে তিনি আবার নির্বাচনে অংশ নিতে পাকিস্তানে ফিরে আসেন, কিন্তু তৎকালীন নওয়াজ শরিফ সরকার থেকে তাকে নির্বাচনে অংশগ্রহনে বাধা দেয়, তারপরেও তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসেন তবে তার অল পাকিস্তান মুসলিম লীগ (এপিএমএল) পাকিস্তানের জন্য কোন সুফল বয়ে আনেনি।
শেষ জীবন
২০০৭ সালের জরুরি অবস্থা জারির সাথে সম্পর্কিত রাষ্ট্রদ্রোহ সহ তিনি আরও বেশ কিছু অভিযোগে জড়িয়ে পড়েন। অভিযোগগুলি দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বছরের পর বছর দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে পরিনত হয়।
২০১৬ সালে উন্নত চিকিৎসার কারণে তার উপর থেকে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর মোশাররফ আবার দেশ ছেড়ে চলে যান।
রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার বিচারকদের তার চলমান মামলার রায় দিতে তিন বছরেরও বেশি সময় লাগে, এই রায়ে পারভেজ মোশাররফকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
কিন্তু মুশাররফের উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজনে দুবাইয়ে থাকার কারণে এমন সাজা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা ছিলনা।
সেসময় হাসপাতালের বিছানা থেকে একটি ভিডিও বার্তায় তিনি বলেছিলেন, তিনি খুব অসুস্থ এবং পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য সক্ষম নন।
সাজা প্রদানের এক মাস পর লাহোরের উচ্চ আদালত পুরো প্রক্রিয়াটিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে।
এটি রায়ের বৈধতা নিয়ে সন্দেহ ছুড়ে দিলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার মৃত্যুদণ্ড বাতিল করেছে কিনা তা পরিষ্কার নয়।
২০২২ সালের জুন মাসে মোশাররফের পরিবার তাকে পাকিস্তানের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার অনুমতির জন্য আহ্বান জানায়। সেনাবাহিনী তার পরিবারকে সমর্থন করবে বলে জানায়।
তবে পাকিস্তানি জনগণের অনেকেই আবার সাবেক সেনাপ্রধানকে গ্রেপ্তারের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাই দুবাই থেকে আর ফিরে আসা হয়নি পারভেজ মোশাররফের।
তথ্য ও ছবি সূত্র: বিবিসি