মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল বলা হয়ে থাকে চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’কে। বৃহস্পতিবার (১১ আগস্ট) ছবিটি ৫০ বছর পূর্ণ করলো।
মানুষের ভালোবাসা পেয়ে ‘ওরা ১১ জন’ কালজয়ী সিনেমার মর্যাদা পেয়েছে আগেই। কিন্তু কেন এই ছবিটি কালজয়ী হয়ে উঠলো, সেটাও নিজের অভিজ্ঞতা আর পর্যবেক্ষণে জানিয়ে দিলেন এই ছবির অন্যতম অভিনেত্রী নূতন।
‘ওরা ১১ জন’ এ নায়ক রাজ্জাকের ছোট বোন (শীলা) এর চরিত্রে অভিনয় করেন নূতন। যিনি পাক হানাদার কর্তৃক ধর্ষিতা হন। নায়ক খসরু যাকে ভালোবাসতেন। দেশ স্বাধীন হলে তিনি হানাদারদের নির্যাতন থেকে মুক্তি পেলেও ক্ষোভ আর অপমানে প্রিয় মানুষ খসরুর হাতের উপরে মারা যান। এই ছবি দিয়েই দ্রুতই দর্শকদের কাছে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। শুধু পরিচিতি নয়, অপূর্ব অভিনয় শৈলী দিয়ে দর্শকদের মনও জয় করেন। তার অভিনয় দেখে সিনেমা হলে বসে সে সময় অনেকেই কেঁদেছেন।
শেষ দৃশ্যে নূতনের অভিনয়কে আর অভিনয় মনে হয়নি দর্শকের। সবার কাছেই মেন হয়েছে এটি যেনো তাদেরই পরিবারের কোনো এক নির্যাতিত বোন। সেই ৫০ বছর আগে অভিনয় করা মুক্তিযুদ্ধের এই অনন্য ছবিটি হৃদয়ের মধ্যে ধরে আছেন এই অভিনেত্রী। গেল ডিসেম্বরেও চ্যানেল আই অনলাইনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, এই ছবির কথা তিনি কখনই ভুলতে পারেন না। এই ছবির কথা স্মরণে আনলেই আবেগাপ্লুত হন।
‘ওরা ১১ জন’ ছবি সম্পর্কে মূল্যায়ণ করতে গিয়ে অভিনেত্রী নূতন বলেন, “এই ছবি তৈরির মূল উদ্দেশ্য ছিল পরবর্তী প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাসটা সেলুলয়েডের ফিতায় ধরে রাখা। সেখানে শতভাগ সফল হন প্রখ্যাত পরিচালক শ্রদ্ধেয় চাষী নজরুল ইসলাম। এ কারণেই এই ছবিটি কালজয়ী। ছবিটি মুক্তি পাবার পর চাষী ভাই আমার অভিনয়ের প্রচণ্ড প্রশংসা করেন। বারবার আমাকে বলতেন, তুই যে অভিনয় করেছিস তা বলার মতো নয়।”
নূতনের মতে, ‘ওরা ১১ জন’ ছবি তার আত্মার অংশ। যখনই এই ছবির কোনো ক্লিপ দেখেন, গান শুনেন, তিনি ফিরে যান একাত্তরে। এই ছবির সাথে তার যে আত্মিক বন্ধন তা তাকে সব সময় রোমাঞ্চিত করে। তিনি মনে করেন প্রয়াত সুমিতা দেবী, পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম, মাসুদ পারভেজ-এর সহযোগিতা না পেলে এই অবিস্মরণীয় ইতিহাসের অংশ তিনি হতে পারতেন না।
‘ওরা ১১ জন’ সম্পর্কে বিস্তারিত:
‘ওরা ১১ জন’ ছবিটি নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক প্রয়াত চাষী নজরুল ইসলাম। প্রযোজনা করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সেই সময়কার ছাত্রলীগ নেতা মো. মাসুদ পারভেজ, যিনি নায়ক সোহেল রানা হিসেবে সর্বজনে পরিচিত। ‘ওরা ১১ জন’ ছবিটির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন খ্যাতিমান বীর মুক্তিযোদ্ধা কামরুল আলম খান খসরু। মুক্তিযুদ্ধের সময় যিনি ঢাকা অঞ্চলের গেরিলা কমান্ডার ছিলেন।
তার সাথে আর যে অন্য ১০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা অভিনয় করেন তাঁরা হলেন- মঞ্জু, অলীন, হেলাল, আবু, আতা, নান্টু, বেবী, মুরাদ, আলতাফ এবং ফিরোজ। এর পাশাপাশি ‘ওরা ১১ জন’ ছবিটিতে তাৎপর্যপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন নায়ক রাজ রাজ্জাক, শাবানা এবং নূতন।
এ ছাড়াও এই ছবিতে অভিনেত্রী রওশন জামিল, মিরানা জামান, সুমিতা দেবী, গুণী অভিনেতা মেহফুজ, সৈয়দ হাসান ইমাম, খলিল, রাজসহ অন্যান্যরা অভিনয় করেন। ছবিতে রাজাকারের চরিত্রে অভিনয় করেন এ.টি.এম শামসুজ্জামান।
ছবিটির সংগীত পরিচালনা করেন প্রখ্যাত সুরকার খোন্দকার নূরুল আলম। ছবিটিতে মোট ‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘আমায় একটি ক্ষুদিরাম দাও বলে কাঁদিস না মা’, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলো যারা’-এই তিনটি গান ব্যবহার করা হয়। ৭২ সালে এই ছবিটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার লাভ করে।
এই ছবিতে নায়ক খসরুসহ অন্য যাঁরা অভিনয় করেন তাঁদের সবাই ছিলেন রণাঙ্গন থেকে ফিরে আসা বীর মুক্তিযোদ্ধা। ‘ওরা ১১ জন’ ছবির শুটিং হওয়ার কিছুদিন আগে যারা যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে আসেন। কয়েকজন ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধন্যও। এই ছবির পরিচালক, কলাকূশলীদের অনেকেই বেঁচে নেই। পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম, নায়ক রাজ্জাক, অভিনেত্রী রওশন জামিল, সুমিতা দেবী, অভিনেতা মেহফুজ, খলিলসহ অনেকেই প্রয়াত হয়েছেন। প্রয়াত হয়েছেন ‘ওরা ১১ জন’ ছবির সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ।