পেঁয়াজের অস্থির বাজারে লাগাম টানতে তৎপর সরকার। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে রাতারাতি দাম বাড়লেও, দ্রুতই দাম কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে সারা দেশে অভিযান পরিচালনা করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। বন্দরে আটকে থাকা পেঁয়াজ খালাসে তৎপর হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এইদিকে বাজারে নতুন মুড়িকাটা পেঁয়াজ আসতে শুরু করেছে। পেঁয়াজের ভালো ফলনের খবর দিচ্ছেন দেশের চাষীরা। নানামুখী পদক্ষেপে দ্রুতই দাম কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আমদানির ৫২ হাজার টন পেঁয়াজ আসছে
ভারত থেকে আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলা ৫২ হাজার টন পেঁয়াজ দ্রুত দেশে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ভারতের বাংলাদেশ হাইকমিশনকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চিঠি পাঠিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ভারত রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার পরও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে একদিনে ৭৪৩ টন পেঁয়াজ এসেছে। আগের এলসিকৃত আরও পেঁয়াজ শীঘ্রই দেশে আনা হবে।
এইদিকে, আকস্মিকভাবে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ। তিনি বলেছেন, ১২০ টাকার পেঁয়াজ একদিনের ব্যবধানে ২০০ টাকা হয়ে যায়, এটা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। রোববার রাজধানীর শের-ই বাংলা নগরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভবনের মাল্টিপারপাস হলে ভ্যাট দিবস ও ভ্যাট সপ্তাহ উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, আগের দিন ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে, আর পরদিনই পেঁয়াজের দাম ৭০-৮০ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীদের বুঝতে হবে, এদেশের জনগণের জন্যই তাদের ব্যবসা। অবশ্যই তারা লাভ করবেন, তাই বলে আগের দিন ছিল ১২০ টাকা, একদিনের মধ্যে ২০০ টাকা হয়ে যায়, এটা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়।
পেঁয়াজের আমদানির বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, মূলত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভারতীয় দূতাবাসে চিঠি পাঠানো হয়েছে। প্রাইভেট সেক্টরের ৫২ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির এলসি খোলা আছে। সেগুলো যাতে ছাড়া হয় সে বিষয়ে তাদের অনুরোধ করা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে দ্রুতই এসব পেঁয়াজ দেশে আসবে।
বাজারে বাজারে অভিযান
অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বেশি দামের আশায় পেঁয়াজ মজুদ করে ফেলেছেন। ফলে খুচরা পর্যায়ে পেঁয়াজের সংকট রয়েছে। অনেক দোকানে পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। মজুতকৃত পেঁয়াজ বাজারে নিয়ে আসতে রোববার সকাল থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় অভিযান পরিচালনা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এছাড়া র্যাব, পুলিশ, ডিবি ও জেলা প্রশাসন থেকেও বাজার তদারকি করা হচ্ছে।
চট্টগ্রামে পেঁয়াজের বাজারে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এতে পেঁয়াজের দাম বেশি নেওয়ায় চার প্রতিষ্ঠানকে ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। নারায়ণগঞ্জে অতিরিক্ত দামে পেঁয়াজ বিক্রি করায় ব্যবসায়ীকে একলাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। বাগেরহাটে অভিযান চালিয়ে তিন ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয়েছে। বান্দরবানে বাজারে অভিযানের খবরে ১১০ টাকা কমেছে পেঁয়াজের দাম। ঝালকাঠিতে ভোক্তা অধিদপ্তর অভিযান পরিচালনা অব্যাহত রেখেছে। বরগুনায় এক রাতে দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে পেঁয়াজের দাম। বাগেরহাটে অভিযানের পর পেঁয়াজের দাম কমে এসেছে। এছাড়া দাম বেশি নেওয়ায় জরিমানা করা হয়েছে তিন ব্যবসায়ীকে।
ভালো ফলনের খবর দিচ্ছেন কৃষকরা
বেশি দাম পাওয়ায় খেত থেকে আগাম মুড়িকাটা পেঁয়াজ তুলছেন পাবনা ও ফরিদপুরের কৃষকরা। এ কারণে পুরান পেঁয়াজের সঙ্গে অনেক বাজারে নতুন পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ ও দেশি মুড়িকাটা পেঁয়াজ ওঠায় শীঘ্রই দাম কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এইদিকে পেঁয়াজের ঘাটতি ও চড়া দামের এই সময়ে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের ভালো ফলনের খবর দিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের চাষিরা। এ বছর জেলার সাড়ে চার হাজার কৃষক কৃষি বিভাগের প্রণোদনায় সাড় চার হাজার বিঘা জমিতে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের আবাদ করেছেন। ভালো ফলন ও ভালো দাম পেয়ে তারা দারুণ খুশি।
সদর উপজেলার রানীহাটি ইউনিয়নের রানীহাটি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, পেঁয়াজচাষি সায়েম আলী, কামাল আলী, মো. মোমিন, রুবেল আলী ও তরিকুল ইসলামেরদের প্রায় পাশাপাশি জমি। এরই মধ্যে কেউ কেউ জমি থেকে পেঁয়াজ তুলে ফেলেছেন। কেউ পেঁয়াজ তুলছেন। এই কৃষকেরা জানান, এক বিঘা করে জমিতে চাষের জন্য কৃষি বিভাগ থেকে তারা প্রণোদনা হিসেবে পেয়েছেন ভারতীয় এন-৫৩ জাতের পেঁয়াজের বীজ, সার-কীটনাশক ও ২ হাজার ৮০০ টাকা। কয়েক বছর ধরেই পেঁয়াজের চাষ করলেও এবার ফলন বেশি হয়েছে বলে জানালেন তারা।
তরিকুল ইসলাম বলেন, গত ১০ থেকে ১২ দিনে তিনি খেতের সব পেঁয়াজ ঘরে তুলেছেন। বিক্রিও করছেন। এক বিঘায় ফলন হয়েছে প্রায় ১০০ মণ। শুরুতে ৩ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি করেছেন। তবে গত শনিবার তার বাড়ি থেকেই এক পাইকার ৫ মণ পেঁয়াজ কিনে নিয়ে গেছেন ৬ হাজার টাকা মণ দরে।
সায়েম আলী জানান, তিনি অল্প কিছু পেঁয়াজ তুলেছেন। পেঁয়াজের আকারও হয়েছে বেশ বড়। একেকটি ওজন ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম। এক বিঘায় ফলন ১১০ থেকে ১২০ মণ হবে বলে আশা করছেন তিনি। কমপক্ষে সাড়ে ৪ লাখ টাকায় পেঁয়াজ বিক্রি করতে পারবেন বলে ধারণা করছেন সায়েম আলী। এ দামে বিক্রি করতে পারলে তার লাভ হবে প্রায় ৪ লাখ টাকা। তবে এ লাভ এখনকার বাড়তি দামের জন্য হবে বলে জানান তিনি।
রানীহাটি এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জোহরুল ইসলাম বলেন, রানীহাটি মৌজায় ১৮ জন কৃষককে প্রণোদনা দিয়ে ১৮ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করানো হয়েছে। সবার জমিতেই ভালো ফলন হয়েছে। বিঘাপ্রতি ১০৫ থেকে ১২০ মণ ফলন হবে বলে আশা করা যায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চাঁপাইনবাবগঞ্জের উপ-পরিচালক পলাশ সরকার বলেন, জেলায় তিন দফায় সাড়ে চার হাজার কৃষককে প্রণোদনা দিয়ে সাড়ে চার হাজার বিঘা জমিতে ভারতীয় এন-৫ জাতের গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের চাষ করানো হয়েছে। বেশির ভাগ কৃষকেরই ভালো ফলন হয়েছে। এটা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। তারা ভালোই লাভের মুখ দেখবেন। এ পেঁয়াজ বাজারে আসার পর দামও কমবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটিতে পেঁয়াজের আকার একটু ছোট হওয়ায় বিঘাপ্রতি ফলন হয়েছে ৮০ থেকে ৯০ মণ। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সালেহ আকরাম বলেন, এই ফলনও কম কিছু নয়। এখানকার চাষিরা এখন সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা মণ দরে পেঁয়াজ বিক্রি করতে পারছেন। হাসি ফুটেছে তাদের মুখে।