কক্সবাজারের টেকনাফ সমুদ্র সৈকতের মহেশখালীয়াপাড়া ঘাটস্থ মেরিন ড্রাইভের পাশেই অবস্থিত নাফ মেরিন শিশু পার্ক। শিশুদের সুষ্ঠু বিনোদনের আশ্বাসে বেসরকারিভাবে এ প্রতিষ্ঠানটি চালু হলেও সম্প্রতি এই পার্কটিতে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে মদ জুয়ার আসর, মদ বিক্রি ও অশ্লীল গান-নাচের অনুষ্ঠান। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন সাধারণ অভিভাবকসহ সর্বস্তরের মানুষ।
অভিযোগ উঠেছে, গত ১৫ দিনের বেশি সময় ধরে এমন আপত্তিকর আয়োজন চলে আসছে। এটাকে কেন্দ্র করে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত টেকনাফের গ্রামে গ্রামে ইজিবাইকে মাইকে করে প্রচার করে চলছে প্রকাশ্যে লটারি বিক্রি। আর মধ্যরাতে অনুষ্ঠান শেষে অনুষ্ঠিত হয় এ লটারির ড্র। এছাড়া পার্কটি জুড়ে প্রকাশ্যে জুয়ার আসর পরিচালনা, মিয়ানমারের বিয়ার-মদ বিক্রি ও পানের অভিযোগ করেছেন এলাকার মানুষ।
পার্কটিতে চলা এই আয়োজনের ভিডিও ফুটেজ ও ছবি প্রতিবেদকের কাছে পাঠিয়েছেন অভিযোগকারীরা।
টেকনাফ সদর ইউনিয়নের খোনকারপাড়া এলাকার আবদুল করিম জানিয়েছেন, শিশু পার্কটি তার বাড়ির খুব নিকটে অবস্থিত। পার্কটি বর্তমানে সন্ধ্যার পর থেকে রাত ১-২ টা পর্যন্ত আপত্তিকর গান, নাচের অনুষ্ঠান হচ্ছে। যেখানে তরুণ, যুবক সহ নানা বয়সের মানুষ টিকেট কেটে প্রবেশ করছেন। অনুষ্ঠানটি গান, নাচ যে পরিস্থিতি তা কোনভাবেই শিশু সুলভ হতে পারে না। শিশু পার্কের নামে এমন আয়োজন সত্যি দুঃখজনক।
টেকনাফের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, একটি প্রভাবশালী চক্র শিশু পার্কটি ঘিরে এই আয়োজন চালিয়ে যাচ্ছে। এটাকে পুঁজি করে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত ৭-৮ টা পর্যন্ত টেকনাফ উপজেলার অলি-গলিতে মাইক যোগে লটারি টিকিট বিক্রি করছে ইজিবাইক আরোহী যুবকরা। প্রতিটি টিকেট ২০ টাকায় আকর্ষণীয় পুরস্কার প্রদানের প্রলোভনে বিক্রি হচ্ছে। যা কিনে পুরষ্কার পাওয়ার জন্য রাতে আবার টিকেট কেটে ঢুকছে পার্কটিতে। আর রাতে ওই পার্কে যা হচ্ছে তা শিশু পার্কের অনুষ্ঠান হতে পারেনা বরং তা অসুস্থ বিনোদন ছাড়া কিছুই নয়।
অনুষ্ঠান দেখেছেন এমন কয়েকজন যুবক আবদুস সালাম, গফুর মিয়া সহ আরো কয়েকজন জানিয়েছেন, পার্কটি বিভিন্ন আঞ্চলিক গানের সাথে যুবক-যুবতী জড়িয়ে ধরে লাফা-লাফি, অশ্লীল অঙ্গ ভঙ্গি সহ যা হচ্ছে তা কোনটাই শিশু সুলভ বলা যাবে না। ওখানে এমন রাতে শিশুরা যাওয়ার কথাও না। আর এ অনুষ্ঠান ঘীরে পার্ক জুড়ে প্রকাশ্যে জুয়ার আসর পরিচালনা হচ্ছে। পার্কের নির্ধারিত কর্মীরা ঘুরে ঘুরে মিয়ানমারের বিয়ার-মদ বিক্রি এবং তা পান করার দৃশ্যও দেখা গেছে বলে জানিয়েছে তারা।
টেকনাফ উপজেলা ওলামা পরিষদের সভাপতি মৌলভী মাহবুবুর রহমান মুজাহেরী জানান, পার্কটিতে গান, নাচ, লাটরি, জুয়া, মদের আসর চলছে। এব্যাপারে গত বুধবার (১ মার্চ) উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে লিখিতভাবেও জানিয়েছেন তারা। তবে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।
শিশু পার্কটিতে অনুষ্ঠানের যে ভিডিও ফুটেজ দেখেছেন উল্লেখ করে জাতীয় শিশু কিশোর সংগঠন খেলাঘর আসরের সাধারণ সম্পাদক কবি এম জসিম উদ্দিন জানান, যা দেখা গেছে এটা শিশু সুলভ বা সুষ্ঠু বিনোদনের অংশ না। এটা শিশু পার্কে অনুষ্ঠানের নামে উন্মাদনা। এটা নিন্দানীয়। শিশু পার্ক অবশ্যই শিশুদের সুষ্ঠু বিনোদনের উপকরণ করতে হবে। প্রশাসনের উচিত বিষয়টিতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া।
পার্কটি পরিচালনাকারী ব্যবস্থাপক ফজলুল কবির টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি জানান, পার্কটিতে যে আয়োজন চলছে তা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে। ওখানে আপত্তিকর বা অশ্লিল কোন কিছুই হচ্ছে না। কেউ প্রমাণ দিতে পারলে সাথে সাথে বন্ধ করে দেয়া হবে। লটারি বিক্রি বা ড্র করে পুরষ্কার প্রদানের সত্যতা স্বীকার করলেও জুয়া বা মদের আসর পরিচালনার বিষয়টি সত্য নয় বলে দাবি করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘পার্কে যা হচ্ছে তা সুষ্ঠু বিনোদন ও বাঙ্গালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান। এটা নিয়ে বিভ্রান্তির কোন সুযোগ নেই।’
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম জানিয়েছেন, টেকনাফের পার্কটিতে অনুষ্ঠানের আয়োজনের জন্য শর্ত সাপেক্ষে অনুমতি প্রদান করেছে প্রশাসন। যদি ওখানে কোন প্রকার শর্ত ভঙ্গ করা হয় তা হলে সেই অনুমতি বাতিল করবে প্রশাসন। তবে ওখানে জুয়া বা মদের যে কথা বলা হচ্ছে তা তদন্ত করে দেখা হবে। এসন কিছু হলে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পুলিশ সুপার জানান, মধ্যরাত পর্যন্ত অনুষ্ঠান আয়োজনের সুযোগ নেই। কয়টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান করা যাবে তা শর্তে বলা হয়েছে। আর অনুষ্ঠান অবশ্যই বাঙ্গালী সংস্কৃতি ও স্থানীয় লোকজ সাংস্কৃতির অংশ হতে হবে। আপত্তিকর কোন কিছু করা যাবে না। বাঙ্গালী সংস্কৃতির সাথে মিলে এমন কোন অনুষ্ঠানকে পুঁজি করে বিভ্রান্তি বা উগ্রবাদীরা বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করলে তাও মেনে নেয়া হবে না।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান অনুষ্ঠানের অনুমতি প্রদানের সত্যতা স্বীকার করে জানান, ইজিবাইক যোগে মাইকে প্রচার করে লটারি বিক্রি, জুয়া বা মদের আসরের তথ্য তিনি জানেন না। হলে আইনগত ব্যবস্থা নেবেন।
তিনিও অনুষ্ঠান অবশ্যই বাঙ্গালী সংস্কৃতি ও স্থানীয় লোকজ সংস্কৃতির অংশ হতে হবে বলে মন্তব্য করে কোন উগ্রবাদীরা বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করলে তাও মেনে নেয়া হবে না বলে জানান।
অন্যদিকে, শিশু পার্কের এসব আপত্তিকর অনুষ্ঠান বন্ধের দাবি জানিয়ে বৃহস্পতিবার বিকাল ৫ টায় টেকনাফ বাস স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করা হয়েছে। সর্বস্তরের তৌহিদী জনতার ব্যানারে আয়োজিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, মৌলভী মনির আহমদ, মৌলভী ইমদাদ উল্লাহ, মোহাম্মদ উল্লাহ রিয়াদ, ইলিয়াস ফারুকী, মোহাম্মদ শফি, আশরাফ আলী প্রমুখ।
কয়েক শত মানুষের অংশগ্রহণে এই মানববন্ধনে শিশু পার্কে অসামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ করা না হলে বৃহত্তর কর্মসূচির হুশিয়ারিও উচ্চারণ করা হয়। মানববন্ধন শেষে এক বিক্ষোভ মিছিলও বের করা হয়।