খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব পালন করে ২৫ ডিসেম্বর। যা বড় দিন বা ক্রিসমাস হিসেবে পরিচিত। যার সাথে জড়িয়ে আছে মা মেরীর মহিমান্বিত দিক। যিশুর জন্মের সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ নিয়ে সঠিক তথ্য না থাকলেও খ্রিষ্টানরা এ দিনকে আনন্দ ও মুক্তির দিন হিসেবে পালন করে থাকে।
বিবি মরিয়ম(আঃ)’র গর্ভে হযরত ঈসা(আঃ) এর জন্ম কাহিনী যে বিধাতার এক অপূর্ব নির্দশন তাতে কোন সন্দেহ নেই। সর্বোপরি বহুবিধ গুণে গুণান্বিত এ রমনী ছিলেন কুমারী মা, পবিত্র নারী, একনিষ্ঠ ধার্মিক, ধৈর্যশীল, সচ্চরিত্রবান, ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞ, আন্তরিক এবং অটল আনুগত্যশীল, নিষ্কলঙ্ক ও স্রষ্টার নির্দেশিত সন্তানের জন্মদাত্রী একজন প্রকৃত মা। তাই তাকে স্রষ্টার নির্দেশ অনুযায়ী বলা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নারী।
পবিত্র কুরআনের সূরা মরিয়মে বর্ণিত হযরত মরিয়ম (আঃ) কে খ্রিস্টানরা ‘মা মেরী’ বলেন। এ মহীয়সী ধর্মপ্রান নারীকে তার মা-বাবা বৃদ্ধ বয়সে জন্ম দেন। একইসঙ্গে সন্তান জন্মদানের প্রচলিত পদ্ধতি ছাড়াই হযরত ঈসা (আ.) কে জন্ম দিয়েছিলেন বলে তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র । সেসময় তাকে ‘উম্মে ঈসা’ বলে ডাকা হতো। যার শাব্দিক অর্থ হলো, ‘ঈসার মা’। বিবি মরিয়ম (আ.) আল্লাহতায়ালার প্রতিটি কথা ও ঐশ্বরিক বাণীকে ভক্তিভরে যে পালন করতেন তার প্রমাণ মিলে ঈসা (আ.) জন্মের ঘটনায়।
মা মেরীর এ অলৌকিকতার ঘটনা পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে। বিবি মরিয়ম (আ.) হলেন হযরত ইমরান (আ.) ও বিবি হান্নাহ্ (আ.)-এর কন্যা এবং হযরত হারুন (আ.)-এর বোন। তার পুরো নাম হযরত মরিয়ম বিনতে ইমরান (আ.)। তিনি হযরত দাউদ (আ.)-এর বংশের ছিলেন। হযরত জাকারিয়া (আ.) তার অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন। হযরত ইমরান ও বিবি হান্নাহর বিয়ের পর অনেক বছর পার হলেও তাদের কোনো সন্তান ছিল না। তারা সন্তানের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতেন নিরাশ না হয়ে। তাদের প্রার্থনা কবুল হলে সন্তান সম্ভবা বিবি হান্নাহ স্রষ্টার কাছে প্রতিজ্ঞা করেন, ‘হে আমার পালনকর্তা! আমার গর্ভে যে সন্তান রয়েছে, তা আমি আপনাকেই ‘নজর’ দিলাম। যেন তাকে মুক্ত রেখে- আমার কাছ থেকে কবুল করে নিন। আপনিই তো সব কিছু শোনেন ও জানেন’ (সুরা আলে ইমরান: ৩৫)।
কিন্তু বিবি হান্নাহ কন্যাসন্তান প্রসব করলে তিনি স্রষ্টার কাছে করা ওয়াদা পালনের বিষয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কারণ তখনকার সময়ে সন্তানকে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করা বলতে বায়তুল মুকাদ্দাসের ইবাদত খানায় সেবকের কাজ করার জন্য দেয়াকে বোঝাতো, সেখানেই তারা থাকতো। তাই মূলত ছেলে সন্তানদেরই একাজে উৎসর্গ করা হতো; ইবাদতখানার সেবার কাজে কোনো কন্যাসন্তানকে উৎসর্গ করার কথা কেউ চিন্তা করতো না। সন্তান প্রসবের পর বিবি হান্নাহ্ বললেন, ‘হে আমার পালনকর্তা! আমি তো মেয়ে প্রসব করেছি। আল্লাহ বেশ জানেন সে যা প্রসব করেছে। ঐ মেয়েটির মতো কোনো ছেলেই যে নেই। তার নাম রেখেছি মরিয়ম। আমি তাকে আর তার সন্তানকে তোমার আশ্রয়ে দিলাম অভিশপ্ত শয়তানের হাত থেকে’ (সুরা আলে ইমরান : ৩৬)।
এরপর বিবি মরিয়ম (আঃ) হযরত জাকারিয়া (আঃ)অভিভাবকত্বে বড় হতে থাকে । তৎকালীন মোসাক আইন অনুযায়ী, কন্যা হবার কারণে শিশু মরিয়ম (আঃ) বাইতুল মুকাদ্দাসের ইবাদতখানার সেবকের দায়িত্ব পালন করতে পারলেন না। কিন্তু জাকারিয়া (আঃ) বিবি মরিয়ম (আঃ)-এর জন্য বাইতুল মুকাদ্দাসের ইবাদতখানায় আলাদা একটি কক্ষ তৈরি করে দিলেন। ঈশ্বরের বিশেষ প্রতিরক্ষায় বিবি মরিয়ম ঐ কক্ষেই বড় হতে থাকেন। হযরত জাকারিয়া (আঃ) প্রতিদিনই বিবি মরিয়মের খোঁজখবর নিতেন। এই সময়ই তিনি ঈশ্বরের সঙ্গে বিবি মরিয়মের নৈকট্যের প্রমাণ পান। একদিন তার কাছে কুঠুরির মধ্যে জাকারিয়া যখন আসলো, দেখতে পেলো: কিছু খাবার রয়েছে। সে জিজ্ঞেস করলো: হে মরিয়ম! এসব তোমার কাছে আসে কোত্থেকে? মরিয়াম বললো, এসব আল্লাহর কাছ থেকেই এসেছে। আল্লাহ যাকে খুশি বেশুমার রুজি দান করেন এ কথা সুনিশ্চিত।’ এভাবেই হযরত মরিয়ম (আঃ) একটি ধর্মীয় পরিবেশের মধ্যে সর্বক্ষণ আল্লাহতায়ালার ইবাদতে নিমগ্ন থাকেন। এই পরিবেশের মধ্য থেকেই তিনি দৈব শিশু হযরত ঈসা (আঃ)-এর জন্মদান করেন।
বিবি মরিয়মের গর্ভজাত সন্তান হযরত ঈসা (আঃ) বা যিশুর জন্ম কথা পবিত্র কুরআনে ও রয়েছে। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বাইবেলে হতে জানা যা, মা মেরীকে গর্ভকালীন সময় ও যীশুর জীবদ্দশায় বেশ প্রতিকূল অবস্থা পাড়ি দিতে হয়।’দুই হাজার বছরের কিছু আগে কুমারী মা মেরির নিজের গর্ভধারনের কথা স্বর্গদূতের কাছে শুনে হতবিহ্বল হন । তিনি তাকে বলেন, ‘স্বামীর শারীরিক স্পর্শ ছাড়াই তিনি কীভাবে সন্তানের জন্ম দেবেন।’ স্বর্গদূত মেরিকে বলেন, ‘ঈশ্বরের পবিত্র আত্মা তার ওপর অবস্থিতি হবে এবং তার প্রভাবেই মেরি গর্ভবতী হবেন এবং তার ছেলে হবে। আর ছেলের নাম যিশু রাখার নির্দেশ দেন।’ এমনকি তখনকার ইহূদী নিয়ম অনুযায়ী কুমারী অবস্থায় গর্ভধারণ করায় তাকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা হতে পারে; এটা জেনে ও ঈশ্বরের প্রদত্ত সন্তান জন্ম দেয়াকে সাদরে গ্রহণ করে তিনি। তাই গর্ভধারণের পরে তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে দূরবর্তী স্থান বেথলেহেম উপত্যকায় বাস করতে চলে যান।
মেরি ছিলেন ইসরাইলের নাজারেথবাসী যোসেফের বাগদত্তা। সৎ, ধর্মপ্রাণ যোসেফ যখন জানতে পারেন মেরি সন্তানসম্ভবা, তখন তাকে আর বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ঈশ্বরের বাণী সম্পর্কে দূত তাকে বলেন, ‘মেরি গর্ভবতী হয়েছে পবিত্র আত্মার প্রভাবে এবং তার যে সন্তান হবে তা ঈশ্বরেরই পরিকল্পনা। যোসেফ যেন মেরিকে সন্দেহ না করে তাকে গ্রহণ করেন। ‘তখন যোসেফ দূতের কথামতো মেরিকে বিয়ে করেন কিন্তু সন্তান জন্ম না নেওয়া পর্যন্ত তাকে শারীরিকভাবে স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকেন।
মেরির সন্তান প্রসবের সময় যখন ঘনিয়ে আসে, ঠিক সেই সময় রোমান সম্রাট অগাস্টাস সিজার আদমশুমারী করেন। তিনি নির্দেশ দেন যার যার পিতৃপুরুষদের শহরে গিয়ে নাম লিপিবদ্ধ করতে হবে। যোসেফের পিতৃপুরুষরা ছিলেন যিহূদিয়ার বেথলেহেমের। যোসেফ তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী মেরিকে নিয়ে নাম লেখাতে সেখানে গেলেন। কিন্তু নাম লেখাতে প্রচুর লোক আসায় তারা থাকার জন্য কোনো জায়গা পেলেন না। পরে একজন লোক তাদের গোয়াল ঘরে থাকতে দিলেন। সেখানেই মেরি সন্তান প্রসব করেন এবং কাপড়ে জড়িয়ে যাবপাত্রে (যে পাত্রে পশুদের ঘাস, খড় বা পানি খেতে দেওয়া হয়) রাখলেন। স্বর্গদূতের কথামতো যোসেফ শিশুটির নাম রাখলেন ‘যিশু’।
যিশুর জন্মের সময় বেশ কয়েকটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে। ওই সময়ে মাঠে ভেড়া চরানো রাখালদের কাছে গিয়ে স্বর্গদূত যিশুর জন্মের খবর দেন। রাখালরা তখনই যিশুকে দেখতে যান এবং উপহার হিসেবে সঙ্গে নিয়ে যান একটি ভেড়ার বাচ্চা। আবার সে সময় আকাশে একটি উজ্জ্বল তারা দেখা যায়। যা দেখে কয়েকজন জোতির্বিদ ও পণ্ডিত বুঝতে পারেন যে, একটি বিশেষ শিশুর জন্ম হয়েছে। তারাও নানাভাবে সন্ধান করে যিশুকে দেখতে আসেন স্বর্ণ ও সুগন্ধি দ্রব্য উপহারাদি নিয়ে।
এভাবে একের পর এক অলৌকিক ঘটনার মধ্য দিয়ে যিশু বড় হতে থাকে মা মেরীর যত্নে৷ ছোট বেলা থেকেই যিশু মানুষের মাঝে মুক্তির বাণী প্রচার করেন। যার ফলে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন শিশু যিশুকে দেখার জন্য দেশের দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসতে থাকে। যিশুর জন্ম ও এই দৈব ক্ষমতার কথা যখন ইহুদি সম্রাট হেরোডোটাসের কাছে পৌঁছলো তখন তিনি বুঝলেন এমন একজন ব্যক্তি এসেছেন যার কারণে ভবিষ্যতে তার নিজের সিংহাসন ও জনগণের ওপর আধিপত্য করার অধিকার হুমকির মুখে পড়বে। সম্রাট যিশুকে হত্যার পরিকল্পনা করেছে জেনে মা মেরী ছেলেকে নিয়ে মিসরে চলে যান।
মিসরে যিশু ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের সঙ্গে বসবাস করেন। এরপর যখন ঈশ্বরের বাণীসমৃদ্ধ ইঞ্জিল কিতাব তার ওপর অবতীর্ণ হয় তখন তিনি বাইতুল মোকাদ্দাসে ফিরে গিয়ে ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে ঈশ্বরের সত্যবাণী প্রচারের কাজে নিয়োজিত হন। তিনি আল্লাহর হুকুমে মাটির তৈরি পাখিকে ফুঁ দিয়ে উড়ন্ত পাখিতে পরিণত করেন; চির অন্ধ, কুষ্ঠরোগীকে ভালো করে তোলেন এবং মরা লোককে বাঁচিয়ে তোলেন; এমনকি তার কাছে আসা লোকেরা নিজেদের ঘরে কি রেখে এসেছে তাও তিনি বলে দিতে পারতেন। এই ক্ষমতা দেখে ইহুদিরা আকৃষ্ট হয়ে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে থাকে।
তবে যিশুর শিক্ষা ও আশ্চর্য কাজ ইহুদি ধর্মগুরুদের ঈর্ষান্বিত করে তোলে এবং তারা রোমান শাসকদের কাছে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে ক্রুশে দিয়ে যিশুকে হত্যা করেন। বাইবেল অনুযায়ী এটাও ছিল ঈশ্বরের পরিকল্পনা। কারণ মৃত্যুর তিন দিন পর যিশু পুনরুত্থান করে স্বর্গে চলে যান। যিশুর জন্মতারিখ থেকেই খ্রিস্টীয় সাল গণনা শুরু হয় বিশ্বে।
ঈশ্বরের নির্দেশ পালন করে একজন কুমারী নারীর গর্ভধারণ,সমাজের কটাক্ষ বাক্যবান উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ, প্রসব বেদনা সহ্য করার অভিজ্ঞতার প্রামাণ্য নিদর্শন হলো বিবি মরিয়ম। যিনি খ্রিষ্টানদের কাছে কেবল যিশুর মা মেরী নন, তিনি হলো স্রষ্টার প্রেমের অনন্য প্রতীক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)