চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

কোটা থাকলেও বঞ্চিত বেশিরভাগ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী

দৈনিক প্রথম আলোর বান্দরবান প্রতিনিধি বুদ্ধজ্যোতি চাকমার একটা কলামে চমকে ওঠার মতো একটা তথ্য পেলাম। গত ২২ অক্টোবর ‘কোটা সংস্কার: সরকারি নিয়োগে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার তরুণরা কেন পিছিয়ে?’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, “স্বাধীনতার ৫১ বছরেও অন্তত ৪০টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী থেকে এখনও পর্যন্ত বিসিএস কর্মকর্তা নেই। যা সংবিধানের মৌলিক অধিকার চেতনাকে ব্যাহত করে।”

আমি সমতলের বাঙালি। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্পর্কে জ্ঞান খুবই সীমিত। ২০০৭-১০ সাল পর্যন্ত যখন চ্যানেল আইয়ে নিউজরুম এডিটর হিসেবে কর্মরত ছিলাম, তখন ক্ষুদ্র জাতিসত্তা নিয়ে একটি এনজিও আয়োজিত কর্মশালায় অংশ নিয়েছিলাম। এই কর্মশালায় দক্ষতার ভিত্তিতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে একটা ফেলোশিপ পাই। আমার সহকর্মী সিনিয়র সাংবাদিক মুজতবা হাকিম প্লেটো বললেন, পাহাড়িদের নিয়ে কাজ করে লাভ নেই। ওদের অস্ত্র আছে। দর কষাকষি করে ওরা ভালোই আছে। আপনি বরং সমতলের অসহায় ট্রাইব নিয়ে ভাবেন। ওদের কেউ নেই।’ বড়ভাইয়ের পরামর্শমতো মধুপুরের গারোদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, ২৫ হাজার জনগোষ্ঠীর মধ্যে মাত্র ১ জন এমবিবিএস ডাক্তার। এমন নয় যে তারা দুর্গম অঞ্চলে বাস করছে। বাড়ির কাছেই ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ।

একদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় নুরুল হক নুর ডাকসু ভিপি হয়ে গেল, অন্যদিকে কোটা থাকার পরও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এর কারণ কী?

এবার মূল আলোচনায় আসি। দেশের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় সন্নিবেশের স্বার্থে রাষ্ট্র উচ্চ শিক্ষা ও সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি প্রবর্তন করেছে। সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদেও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। ১৯৮৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশের উপজাতি/ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী সম্প্রদায়কে অনগ্রসর শ্রেণি বিবেচনা করে সরকারি চাকরিতে ৫% এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে আসন সংখ্যার ভিত্তিতে বিভিন্ন হারে কোটা ব্যবস্থা চালু করা হয়। পরে ২০১৫ সালে এক গেজেটের মাধ্যমে ‘উপজাতি’ শব্দটি প্রত্যাহার করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য কোটা বহাল রাখে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে ৫০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে এবং মোট জনসংখ্যা ১৬ লাখ ৫০ হাজার ১৫৯ জন। যা দেশের মোট জনসংখ্যার ১ ভাগেরও কম। এরমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৫৬%, সমতলে ৪৪%।

আবারও বুদ্ধজ্যোতি চাকমার কলামে ফেরা যাক। তিনি লিখেছেন, ‘বান্দরবানের ম্রো জনগোষ্ঠীর কথা ধরা যাক। পার্বত্য বান্দরবানে বসবাসরত ১২ টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে তাঁরা দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ। মারমাদের পরে তাঁদের স্থান। সরকারি পরিসংখ্যানে তাদের জনসংখ্যা প্রায় ৪২ হাজার। এই জনগোষ্ঠী থেকে কোনো বিসিএস কর্মকর্তা নেই। এমনকি বিসিএসের প্রাথমিক পরীক্ষায়ও যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি। ম্রোদের মতো আরও ছয়টি জনগোষ্ঠীর একই অবস্থা। জনগোষ্ঠীগুলো হলো বম, পাংখুয়া, লুসাই, খুমি, খিয়াং ও ত্রিপুরা। যদিও রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বিসিএস কর্মকর্তা রয়েছেন। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় বসবাসরত চাক জনগোষ্ঠীর একজন চিকিৎসক রয়েছেন। প্রায় তিন হাজার জনসংখ্যার জনগোষ্ঠীর মধ্যে তিনি একমাত্র প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা। বম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার। এই পর্যন্ত কয়েকজন বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সোনার হরিণের ধারে-কাছেও যেতে পারেননি। সমতলের বিভিন্ন জেলায় ৩৯টি জনগোষ্ঠীর বসবাস। মণিপুরী, গারো, হাজং, সাঁওতাল ও রাজবংশী ছাড়া সম্ভবত অন্য জনগোষ্ঠী থেকে ক্যাডার সার্ভিসে কেউ আছেন কিনা জানা নেই।’

তাহলে এবার যোগসূত্র মেলানো যাক। সম্প্রতি কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামে পাহাড়ে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়ার চেষ্টা করছে। কারা এই কুকি-চিন? পাহাড় নিয়ে যারা ঘাঁটাঘাঁটি করেন, তারা বলছেন– ম্রো, বম, পাংখুয়া, খুমি ও খিয়াং জনগোষ্ঠীর সুবিধাবঞ্চিত তরুণরা কেএনএফের ছাতায় আশ্রয় নিচ্ছে। খেয়াল করুন, এই সুবিধাবঞ্চিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর কথাই লিখেছেন বুদ্ধজ্যোতি চাকমা।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কেএনএফ দাবি করেছে, তাদের এই সংগ্রাম চাকমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে। এ প্রসঙ্গে আলাপ করেছিলাম বিশিষ্ট সামরিক বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম (অব.)-এর সাথে। তিনি জানালেন, পাহাড়ে চাকমাদের আধিপত্যে অন্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোণঠাসা। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ কোটার বেশিরভাগ ভোগ করছে এমন একটা জনগোষ্ঠী, যাদের ৭৩ ভাগ শিক্ষিত। এই বৈষম্যের কারণেই পাহাড়ে অস্থিরতা বাড়ছে। এরইমধ্যে সুবিধাবঞ্চিত ম্রো, বম, পাংখুয়া, খুমি ও খিয়াংরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। গড়ে তুলেছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট। এই বিপথগামী জনগোষ্ঠীকে মূলস্রোতে না মেশাতে পারলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে উঠবে। পার্বত্য ৩ জেলার মোট জনগোষ্ঠীর ৫০ ভাগ বাঙালি। এদের শিক্ষার হারও তুলনামূলক অনেক কম, মাত্র ২৩ শতাংশ। পৃথিবীর ইতিহাসে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত জনগোষ্ঠী তাদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তুলতে দেখা যায়। বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালী জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা না পেয়ে তারাও পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র আন্দোলনের দিকে ধাবিত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায়নি। তখন পরিস্থিতি সামাল দেয়া রাষ্ট্রের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।

শুরু হলো আমার সাংবাদিকসুলভ অনুসন্ধান। ২২ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত কলামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহফুজ পারভেজ লিখেছেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাত্র ২৯ শতাংশ জনগোষ্ঠী চাকমা, তবে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে এরা প্রায় ৫৬ ভাগ কোটা সুবিধা পাচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে গত ১০ বছরে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পাহাড়ি ৫৬ ভাগ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটার ৮০% আসন দখল করেছে। যার মধ্যে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের লোকজনই সিংহভাগ দখল করে আছে। এ কারণে পিছিয়ে পড়ছে সমতলের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা।

সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট জনসংখ্যার ৫০% বাঙালি। শিক্ষার দৌড়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিরা অনেক পিছিয়ে। শিক্ষার হার মাত্র ২৩ ভাগ। অনগ্রসর হলেও তাদের জন্য কোটা নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের সুবিধাবঞ্চিত বাঙালিরাও এখন বিশেষ কোটা দাবি করছে। এ প্রসঙ্গে দুই পুরুষ ধরে বান্দরবানে বসবাসকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক মো. শাহজালাল বলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী বাঙালিরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো জীবনযাপন করছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটার বদৌলতে উচ্চ শিক্ষা ও চাকরিতে বিশেষ সুবিধা পেলেও একই ভৌগোলিক অবস্থানে বসবাসরত বাঙালিরা সেই সব সুবিধা থেকে বঞ্চিত। চাকমাদের তুলনায় শিক্ষাদীক্ষা ও সরকারি চাকরিতে অনেক পিছিয়ে বাঙালিরা। যদিও পার্বত্য জেলাগুলোর মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই বাঙালি। উচ্চ শিক্ষা ও সরকারি চাকরিতে এই অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ কোটা ব্যবস্থা চালু করার দাবি জানাই। এটা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার।’

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)