সেটি ছিল বিশ্বকাপের ১৩তম আসর, বসেছিল মেক্সিকোতে। ১৯৮৬ সালের মহাযজ্ঞ স্মরণীয় হয়ে আছে ডিয়েগো ম্যারাডোনার আঁচড়ে। ২৫ বর্ষী ম্যারাডোনার বাহুতে তখন নেতৃত্বের আর্ম ব্যান্ড। আর্জেন্টিনার শিরোপাজয়, সব ছাপিয়ে এখনও আলোচনার শীর্ষে থাকে কোয়ার্টারে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ডিয়েগোর বিখ্যাত ‘হ্যান্ড অব গড’ গোল।
স্বাগতিক হওয়ায় মেক্সিকো এবং ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় ইতালি ’৮৬-র বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার সুযোগ পায়। ২৪ দলের টুর্নামেন্ট, প্রথমবারের মতো বিশ্বমঞ্চে খেলতে এসেছে কানাডা, ডেনমার্ক এবং ইরাক।
অংশ নেয়া অন্যান্য দলগুলো- সাউথ কোরিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে, উরুগুয়ে, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, স্কটল্যান্ড, সোভিয়েত ইউনিয়ন, স্পেন এবং ওয়েস্ট জার্মানি।
ওই আসরে একটি নতুন ফরম্যাট চালু হয়েছিল। ২৪ দলকে ছয়টি গ্রুপে ভাগ করা হয়। প্রতি গ্রুপ থেকে সেরা দুটি দল এবং তৃতীয় হওয়াদের মধ্য থেকে চারটি সেরা দল নকআউট পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে।
গ্রুপপর্বের প্রথম ম্যাচ, ১৯৫৪ সালের পর বিশ্বকাপে আসা সাউথ কোরিয়াকে ৩-১ গোলে হারায় আলবিসেলেস্তেরা। দ্বিতীয় ম্যাচে ইতালির সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে। শেষ ম্যাচে বুলগেরিয়াকে ২-০ গোলে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় ১৯৭৮ সালের শিরোপাজয়ী আর্জেন্টিনা।
শেষ ষোলোর লড়াইয়ে উরুগুয়ের বিপক্ষে ১-০ গোলে জিতে কোয়ার্টারের টিকিট কাটে আর্জেন্টিনা। শেষ আটে আকাশী-নীলদের প্রতিপক্ষ ছিল ইংল্যান্ড।
সাউথ আটলান্টিক মহাসাগরে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় আর্জেন্টিনা ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের আবহ এসে ভর করেছিল মেক্সিকো বিশ্বকাপেও। তার কারণ ছিল একটাই, আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ড কোয়ার্টার ফাইনাল লড়াই। ‘হ্যান্ড অব গড’ ও ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’ -এই দুই গোলের কারণে সেই ম্যাচটি ইতিহাসের পাতায় স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে।
আলোচিত ওই ম্যাচে ২-১ গোলে জিতেছিল আর্জেন্টিনা। সেদিন ম্যারাডোনা করা দুটি গোলই স্থায়ী জায়গা করে নেয় ইতিহাসের পাতায়। প্রথমটি ছিল বিখ্যাত ‘হ্যান্ড অফ গড’ গোল। ৫১ মিনিটের মাথায় ইংল্যান্ড গোলরক্ষক পিটার শিলটনকে পাশ কাটিয়ে বলের গতিপথ পাল্টে দেন আর্জেন্টাইন গ্রেট। যাতে ছিল হাতের ছোঁয়া!
ম্যাচের ৫৫ মিনিটে ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’ করে বসেন ম্যারাডোনা। লুই চুচিয়োপ্পোর কাছে বলের নিয়ন্ত্রণ হারান হোসে লুইস কুসিউফো। পরে হেক্টর হেনরিক পাস নিয়ে বল ম্যারাডোনার কাছে ঠেলে দেন। ইংলিশ ডিফেন্ডারদের যেভাবে তিনি বল নিয়ে কাটিয়ে এগিয়েছিলেন, তা আজও সবার কাছে বিস্ময়কর। মাঝ মাঠের খানিক আগে পায়ে বল পান ম্যারাডোনা। প্রতিপক্ষের দুজনকে কাটিয়ে ডান প্রান্ত দিয়ে বল নিয়ে তীব্র গতিতে ছুটতে থাকেন।
গ্যারি স্টিভেন্স ও পিটার রিড তাকে বাধা দিতে চাইলেও ব্যর্থ হন। রিড চেষ্টা করেছিলেন ম্যারাডোনার পিছু আসতে, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সবশেষ পেনাল্টি বক্সের কোণায় ইংল্যান্ডের সেন্টার-ব্যাক টেরি ফেনউইক হাফ চ্যালেঞ্জ করেন। এ সময় আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি শরীর সামান্য ঘুরিয়ে বাঁ-পায়ের কোণাকুণি শটে গোলরক্ষককে পরাস্ত করেন, বল জালে জড়িয়ে দেন। মাত্র ১১ সেকেন্ড সময় নিয়ে ৬০ গজ দৌড়ে ম্যারাডোনা গোলটি করেছিলেন। যেটি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ একক কৃতিত্বে করা গোল হিসেবে স্বর্ণখচিত হয়ে আছে।
২০২০ সালের নভেম্বরে মারা যাওয়া ম্যারাডোনা বহু বিতর্কিত গোল তথা প্রথম গোলটি নিয়ে বলেছিলেন, ‘গোলটি ছিল ম্যারাডোনার সামান্য মাথা এবং ঈশ্বরের হাত দিয়ে করা।’
সেমিফাইনালেও নিজের জাদু দেখান ম্যারাডোনা। তার জোড়া গোলে বেলজিয়ামকে ২-০ ব্যবধানে হারিয়ে আর্জেন্টিনা শিরোপার মঞ্চে চলে যায়। প্রতিপক্ষ ছিল ওয়েস্ট জার্মানি।
৩৬ বছর আগে, ২৯ জুনের এই দিনে আজতেকা স্টেডিয়ামে ফাইনাল ম্যাচে নেমেছিল আর্জেন্টিনা। শুরুতে ২-০ গোলে এগিয়ে থাকলেও ওয়েস্ট জার্মানি তা শোধ করলে স্কোরলাইন ২-২ করেছিল। ৮৩ মিনিটে হোর্হে বুরুচাগার গোলে চ্যাম্পিয়ন হয় আলবিসেলেস্তেরা।
ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ ট্রফিতে চুম্বনের সেই দৃশ্য আজও ফুটবলপ্রেমীর হৃদয়ে আঁকা স্মৃতির তুলির আঁচড়ে। সেই শেষবার বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরেছিল আর্জেন্টিনা।