মেয়েদের ফুটবলে সাউথ এশিয়ান চ্যাম্পিয়নরা দেশে ফিরেছেন। ট্রফি উঁচিয়ে, হাত নেড়ে ছাদখোলা বাস থেকে অভিনন্দনের জবাব দিয়েছেন ঢল নামা উৎসুক জনতার। গত সোমবার শিরোপার মঞ্চে নেপালকে ৩-১ গোলে হারানোর পর দেশে এখনও বাঁধভাঙা উৎসব। আজ সেই উৎসবের পারদ চরেছিল সপ্তমে। দেশের ফুটবলের জন্য রঙিন দিনটিতে ঠিক যা যা ঘটেছে— দেখে নেয়া যাক একপলকে।
দেশের পথে
কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালায় যেদিন সাবিনা-সানজিদারা প্রথমবারের মতো শিরোপা উঁচিয়ে ধরেছিলেন, সেদিন থেকেই অপেক্ষা। সময়ের সাথে চ্যাম্পিয়নদের ফেরার সেই অপেক্ষা বেড়েছে বহুগুণ। কৃষ্ণা-তহুরারা কখন দেশে ফিরবেন, তাদের জন্য যে আয়োজনের কমতি নেই। ছাদখোলা বাস, বিমানবন্দরে উপচে পড়া ভিড়, বুধবার সকাল থেকেই নেমেছিল মানুষের ঢল। সেই অপেক্ষা মিটেছে দুপুরে। তার আগে হিমালয়ের দেশ নেপালে লাল-সবুজের বিজয় কেতন উড়িয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা দুপুর ১২টায় দেশের পথে রওনা হন।
যখন রানওয়েতে
দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে রূপনা-স্বপ্নাদের বহনকারী বিমান হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে স্পর্শ করে। তার আগে মারিয়াদের সংবর্ধনা শুরু হয় উড়োজাহাজের ভেতরেই। জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার সানোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে কাটা হয় কেক। বিমান রানওয়ের শেষ মাথায় থামতেই চ্যাম্পিয়নদের সঙ্গে চলে একদফা কেক পর্ব আর ফটোসেশন।
ফুলের মালা ও আরেকটি কেক
মেয়েরা যখন দেশে পৌঁছান, ঘড়িতে ঠিক দুপুর ১.৪৫ মিনিট। বিমানবন্দরের বাইরে তখন মানুষের ঢল। ভেতরে ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, ক্রীড়া সচিব, বাফুফের এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্যরা চ্যাম্পিয়নদের দেন উষ্ণ অভ্যর্থনা। ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। করানো হয় মিষ্টিমুখ, কাটা হয় আরেকটি বড় কেক।
সেই দেড় ঘণ্টা
বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ থেকে ছাদখোলা বাস পর্যন্ত আসতে সাবিনাদের লেগে যায় প্রায় দেড় ঘণ্টার মতো! পৌনে দুইটায় বিমান থেকে নামা চ্যাম্পিয়নরা যখন বাসে উঠে পড়েন, ঘড়িতে সাড়ে তিনটার বেশি। এ সময়ের মাঝে বিমানবন্দরে ঘটে যায় অনেককিছু। সাবিনাদের জায়গা করে দিতে সংবাদকর্মী-জনতার চাপের মুখে পুলিশকেও হতে হয় কঠোর। সাংবাদিকদের সাথে তো মৃদু ধাক্কাধাক্কিও হয়ে যায় নিরাপত্তাকর্মীদের। তারপর বাইরের ভিড় ঠেলে বাস পর্যন্ত আসতে আরেকদফা জনতার ঢল অতিক্রম।
অবশেষে ছাদখোলা বাস
ম্যাচের ঝক্কি, ভ্রমণক্লান্তি এবং বিমানবন্দরে দেড়ঘণ্টার দীর্ঘ সময় শেষে সেই ছাদখোলা বাসে ওঠেন সানজিদা-সাবিনারা। চ্যাম্পিয়নদের জন্য বিশেষ রাঙানো বাস। যা প্রস্তুত করা হয়েছে একদিনেই। সানজিদা আক্তারের ফেসবুক পোস্টের সূত্র ধরে আলোচনায় চলে এসেছিল হুডখোলা বাসের প্রসঙ্গ। পরে লম্বা সময় সেই বাস থেকে সমর্থকদের অভিবাদনের জবাব দেন সাউথ এশিয়ান নতুন চ্যাম্পিয়নরা।
চিরচেনা জ্যামের দেখা
ফুলেল শুভেচ্ছা, কেক কাটা শেষে ছাদখোলা বাসে বাফুফে ভবনের পথে রওনা হন সাবিনারা। বিমানবন্দর থেকে কিছু পথ নির্বিঘ্নেই পার হয় বাস। বনানী ফ্লাইওভারের কাছে এসে পড়ে জ্যামের মুখে। উৎসুক জনতার ভিড়ের মধ্যে তারপর থেকে থেকেই বিরতি দিয়ে জ্যামে পড়ে লাল-সবুজ মেয়েদের বাস।
তহুরা-রূপনাদের ছাদখোলা বাসটি কাকলি, জাহাঙ্গীর গেট হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে দিয়ে বিজয় সরণী-তেজগাঁও-মৌচাক ঘুরে কাকরাইল আসে। সেখান থেকে ফকিরাপুল, আরামবাগ, শাপলা চত্বর দিয়ে মতিঝিলে বাফুফে ভবনে যখন পৌঁছায়, তখন দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা।
শঙ্কা-অস্থিরতা এবং শেষে দুর্ঘটনা
বিমানবন্দর থেকে বাফুফে ভবন পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার পথে সাফজয়ীরা পড়েছেন জ্যামের শঙ্কায়, গরমে কিছুটা অস্থিরও ছিল উল্লাসের মাত্রা! ছাদখোলা বাসটি বনানীতে আসলে ঘটে যায় দুর্ঘটনা। পথচারী-সেতুর বিলবোর্ডে আঘাত পান ঋতুপর্ণা চাকমা। তাৎক্ষণিক অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে তারকা মিডফিল্ডারের কপালে দিতে হয় তিনটি সেলাই। অ্যাম্বুলেন্সে করেই তাকে নেয়া হয় বাফুফে ভবনে। সবশেষ খবর, সুস্থ আছেন ঋতুপর্ণা।
পথজুড়ে ঢল
ছাদখোলা বাসটি দীর্ঘ ১৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়। প্রায় পুরো রাস্তাজুড়ে দু-ধারে ছিল বিপুল সংখ্যক মানুষের ঢল। ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় রাজপথ। হাততালি আর স্লোগানে স্লোগানে গলা চড়ানো সমর্থকদের ভিড় ঠেলে যাত্রা সম্পন্ন করে সাবিনা-সানজিদারা।
এই পথ যদি শেষ না হয়!
মারিয়া-কৃষ্ণারা বিখ্যাত গানটির লাইন দুটো গেয়েছিলেন কিনা জানা যায়নি! কারণ বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ছাদখোলা বাস এবং উৎসুক জনতার অভিবাদন আর একবার মাত্র এসেছিল। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়ের পর আকরাম-বুলবুলরা যেভাবে মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিলেন, প্রথমবার সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসা সাবিনা-সানজিদারাও পেলেন তেমন মনে রাখার মতো উষ্ণ অভ্যর্থনা।
অবশেষে বাফুফে সভাপতির সাক্ষাৎ
চার ঘণ্টার বেশি সময়ের রাজসিক যাত্রা শেষে কাজী সালাউদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয় চ্যাম্পিয়নদের। সেখানে মেয়েদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন বাফুফে সভাপতি। ছেলেদের অনূর্ধ্ব-১৬ ও মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৫ ফুটবল দলের সদস্যরাও স্বাগত জানান সাউথ এশিয়ান ফুটবলের মুকুটধারীদের।
অনেক কথা জমা
বাফুফে ভবনে প্রেস কনফারেন্সে শিরোপাজয়ী অধিনায়ক সাবিনা বললেন, ‘লক্ষ্য থাকবে দেশের মানুষকে হাসিখুশি রাখার। কারণ এতকিছুর পরে এখন আর বলার অবকাশ নেই, বাংলাদেশের মানুষ ফুটবলে কতটা আসক্ত এবং ভালোবাসে। সবসময় সাথে ছিলেন, ভবিষ্যতেও সমর্থন করে যাবেন। আশা করি আমরা দেশকে আরও ভালো ট্রফি উপহার দিব।’
কোচ গোলাম রব্বানি ছোটনের কণ্ঠেও একই সুর, দেশকে আরও সাফল্য এনে দিতে চান তিনি। চ্যাম্পিয়ন দলের স্মৃতিচারণ করে বললেন, ‘২০১৬ সালে আমাদের ক্যাম্প শুরু হয় ৩৫ জন নিয়ে। সেই পথচলায় এখন ক্যাম্পে ৭০ জনের মতো আছে।’
এবার ফুরসত গা এলিয়ে দেয়ার
গ্রুপপর্বে চারটি ম্যাচ, সেমিফাইনাল ও ফাইনাল মিলিয়ে ব্যস্ত একটা সময় মাঠেই কাটিয়েছে সাবিনা খাতুনের দল। শিরোপার মঞ্চে ওঠার লক্ষ্য নিয়ে যাওয়া দলটি এসেছেন সেরার মুকুট পরে। দেশে ফিরে দিয়েছেন দীর্ঘ সময়ের পথ পাড়ি। তারপর রীরোচিত অভ্যর্থনা। সবতো হল ঠিকঠাক, এবার তো অবসর নেয়াই যায়! সেটা নিশ্চয় খুব দীর্ঘায়িত করবে না অদম্য মেয়েরা। কারণ তাদের সামনে আরও বড় স্বপ্ন, দেশের মানুষের বড় প্রত্যাশা। তার আগে জন্মভূমিতে ফিরে শান্তির একটা ঘুমের জন্য বিছানায় গা এলিয়ে দেয়াই আগে!