চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

‘ফুল হয়ে ফুটতে’ চান কলি, বাংলাদেশকে দিতে চান স্বর্ণপদক

জাকার্তায় ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ শ্যুটিং

ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় শনিবার থেকে শুরু হচ্ছে আইএসএসএফ ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ শ্যুটিং প্রতিযোগিতা। মেয়েদের ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে ব্যক্তিগত ও দলীয় ইভেন্টে অংশ নেবে বাংলাদেশ। স্পন্সর জটিলতায় শেষ মুহূর্তে দুই শ্যুটার অংশ নিতে পারছেন না। যেজন্য এবার বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বে থাকছেন না কোনো পুরুষ প্রতিযোগী। শুধুমাত্র নারী ইভেন্টেই থাকছে লাল-সবুজের প্রতিনিধিত্বকারী।

ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ শ্যুটিংয়ে বাংলাদেশের হয়ে এবার লড়বেন- কামরুন নাহার কলি, সাহেরা আরেফিন, নাফিসা তাবাসসুম এবং সাজিদা হক। অলিম্পিক র‍্যাঙ্কিংয়ে ১৫তম স্থানে থাকা কলির হাত ধরে পদক জয়ের স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। এমন হলে দেশের ক্রীড়াঙ্গন নতুন ইতিহাস জন্ম দেবে।

Bkash July

মিশরের কায়রোতে গতবছরের অক্টোবরে বিশ্ব শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে ৬২৯ দশমিক ২ স্কোর তুলেছিলেন কলি। বাংলাদেশি শ্যুটারদের মধ্যে ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে এটি কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে সেরা স্কোর। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ লড়াইয়ে ১৩৪ জন প্রতিযোগীর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের মেয়ে ১৪তম হন। তখনই আভাস মিলেছিল, কলি ফুল হয়ে ফুটলে দেশের শ্যুটিংয়ে ফিরতে পারে সোনালী সাফল্য।

কায়রোর মাসখানেক পর সাউথ কোরিয়ার দ্যাগুতে এশিয়ান এয়ারগান চ্যাম্পিয়নশিপে দারুণ পারফরম্যান্স দেখিয়ে সকলের দৃষ্টিতে চলে আসেন কলি। ফাইনালে উঠে তাক লাগিয়ে দেন। প্রথমবার শ্যুটিংয়ের কোনো চ্যাম্পিয়নশিপে পদক জয়ের আশা জাগান। ফাইনালেও ছিলেন দারুণ ছন্দে। তবে ০.৩ পয়েন্টের জন্য হাতছাড়া হয় ব্রোঞ্জ পদক। ২৫৯.১ পয়েন্ট পেয়ে চতুর্থ স্থানে থেকে আসর শেষ করতে হয়। ক্যারিয়ারের তৃতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ফাইনালে খেলার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কলি এগিয়ে যেতে চান আরও অনেকদূর। অতীতের আক্ষেপ পেছনে ফেলে জাকার্তায় আইএসএসএফ ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে তার হৃদয়ে স্বর্ণপদক জয়ের আকাঙ্ক্ষা।

Reneta June

জাকার্তা থেকে চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারীতায় কামরুন নাহার কলি শোনালেন সেসব আশার কথাই।

‘মিশরে যখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ খেললাম, ভালো একটা স্কোর হল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভালো স্কোর করার পরও ফাইনালে যেতে পারলাম না। সেখানে একটা আফসোস থেকে যায় যে খুব অল্পের জন্য, ০.৮ স্কোরের জন্য ফাইনালে যেতে পারিনি। বাংলাদেশে ফিরে আবারও শ্যুটিং অনুশীলন শুরু করি, তখন সর্বপ্রথম এটাই লক্ষ্য ছিল যে পরবর্তীতে অবশ্যই ফাইনাল খেলব। অভিজ্ঞতা থেকে যেসব শিখেছি, ভুলগুলো যা ধরতে পেরেছি, ওইসব নিয়ে কাজ করেছি। কোচ আমাদের আবারও ট্রেইন করেছেন। তারপর কোরিয়ায় এশিয়ান এয়ারগান চ্যাম্পিয়নশিপ ছিল। ০.৩ পয়েন্টের জন্য ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করতে পারিনি। তবে ফাইনালে যেতে পেরেছিলাম। খুব অল্পের জন্য পদক মিস করি।’

‘এবার আরও ভালো প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি। আফসোস করার কোনো রেশই যেন না থাকে। এবার যেন দেশের জন্য ভালো ফলাফল নিয়ে যেতে পারি। যাতে একটা স্বর্ণপদক নিতে পারি, সেই ইচ্ছা নিয়ে সেরকম প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি। আমাদের সবার অনুশীলন ভালো হচ্ছে। আমি এবং বাকি যারা টিমমেটরা আছে, তাদেরও অনুশীলন ভালো হচ্ছে। আশা করি সবাই দেশের জন্য কিছু নিয়ে যেতে পারবো। দেশের জন্য সম্মান অর্জন করতে পারবো আশা রাখি।’

বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান কলি। হুট করেই শ্যুটিং জগতে পা রাখেন। কীভাবে আজ শ্যুটার হিসেবে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন, সেটির বিবরণও অনর্গল বলে গেলেন তিনি।

‘শ্যুটিং সম্পর্কে আসলে তেমনকিছু জানতাম না। যেহেতু বাংলাদেশে শ্যুটিংটা এখনো তেমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি, তাই এসম্পর্কে তেমনভাবে জানা হয়নি। আমাদের নারায়ণগঞ্জের চাষাড়াতে একটা রাইফেল ক্লাব আছে। যখন নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবের সামনে দিয়ে স্কুলে-কোচিংয়ে যেতাম, মনের ভেতর প্রশ্ন জাগত আসলে এই রাইফেল ক্লাবে কী করানো হয়। যখন বড় হলাম, কলেজে উঠলাম, একদিন ক্লাবে গিয়ে জানতে চাইলাম আসলে রাইফেল ক্লাবে কী করানো হয়। তখন ২০১৭ সাল। ভর্তি হলাম। ২০১৭ সালে তেমন অনুশীলন করা হয়নি। ২০১৮ সালে আমার প্রথম শ্যুটিংয়ে হাতেখড়ি।’

‘তারপর ইন্টার ক্লাব এয়ার চ্যাম্পিয়নশিপ, এরকম দুই-তিনটা ছোট ছোট আসরে অংশ নেই। যখন পরপর ভালো ফলাফল করতে শুরু করি, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নারায়ণগঞ্জ রাইফেলস ক্লাব থেকে প্রত্যয়নপত্র নিয়ে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীতে চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড় হিসেবে যোগদান করি। বাংলাদেশ নৌ বাহিনী আমাকে সমর্থন দিয়েছে বলেই আজকের অবস্থানে এসেছি। তারা আমাকে স্পন্সর করেছে, ভালো অস্ত্র দিয়েছে। অন্যান্য সুবিধা দিয়েছে।’

পরিবারের কেউ কখনো খেলাধুলার সাথে জড়িত না থাকলেও খেলাধুলার প্রতি ভালোবাসা এবং খুব সমর্থন জুগিয়ে যাওয়াতে আজকের অবস্থানে আসতে পেরেছেন কলি। বিশেষ করে মায়ের সমর্থন ও প্রত্যাশাটা কত বিশাল সেটিও জানালেন।

‘‘আম্মু অনেকবেশি সমর্থন করেন। আর্থিক, মানসিক, সবরকম সমর্থন দেন। ভালো কিছু করার জন্য অনুপ্রাণিত করেন। উনি আমাকে সবসময় বলেন, ‘মা তোমাকে দেশের জন্য কিছু করতেই হবে। তোমাকে অলিম্পিকের পদক আনতেই হবে। আমি চাই তুমি অলিম্পিক থেকে পদক নিয়ে আসো।’ আসলে পরিবারের সমর্থন অনেক পেয়েছি। একজন মেয়ে হিসেবে খেলাধুলায় এগিয়ে যাওয়ার জন্য পরিবারের সমর্থন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পারিবারিক সমর্থন না পেলে মুক্ত মানসিকতা নিয়ে খেলা যায় না। আমি ভীষণ ভাগ্যবান, পরিবারের ভালো সমর্থন পেয়েছি।’’

পরিবারের বাইরে ফেডারেশন ও কোচিং স্টাফদের থেকেও শ্যুটাররা ভালো সমর্থন-সহযোগিতা পাচ্ছেন বলেও কলি জানালেন। তাদের কারণে প্রস্তুতিটা জোর কদমে এগিয়ে চলেছে বললেন।

‘আমাদের দুইজন কোচ আছেন। একজন গোলাম সালাউদ্দিন শিপলু ভাই, আরেকজন আন্তর্জাতিক কোচ ইরানের মোহাম্মাদ জাহেদ রেজাই- এই দুইজন মানুষ আমাদের যেমন টেকনিক্যাল সমর্থন দিচ্ছেন, তেমন মানসিক সমর্থনও দিচ্ছেন। আমাদের যারা অফিসিয়াল হিসেবে আছেন, জয়েন্ট সেক্রেটারি হিসেবে মোশতাক ভাই, রত্না আপু, বিশেষ করে ফেডারেশনের মহাসচিব ইন্তেখাবুল হামিদ স্যার, অনেক অনেক মানসিকভাবে সমর্থন দেন। আমরা যখন দেশের বাইরে আসি, যেন আনন্দে থাকি উনি সেই চেষ্টাটা করেন। যাতে আমরা ভালো মুড নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারি। আমাদের ইয়োগা টিচার আছেন। উনি আমাদের বিভিন্ন জিনিস ট্রেইন করেন। কীভাবে মেডিটেশন করতে হয়, কীভাবে প্রতিযোগিতার আগে এবং চলাকালে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, নিজের মনকে কীভাবে কন্ট্রোল করে আমরা গেমটা সুন্দরভাবে খেলতে পারি, সেজন্য ইয়োগা গুরু রাখা আছে। সবমিলিয়ে প্রস্তুতি ভালো।’

ক্রিকেট-ফুটবল নিয়ে গণমাধ্যমের ফোকাস থাকলেও দেশের ক্রীড়াঙ্গনে বহু সাফল্য এনে দেয়া শ্যুটিং নিয়ে প্রচার-আগ্রহ কমই বলা যায়। একসময় সাফ গেমসে গোল্ড মেডেলের দেখা নিয়মিতই মিলেছে। কমনওয়েলথ গেমস আর এশিয়ান গেমসেও পদক শ্যুটিং থেকে আসার ইতিহাস আছে। কলি চান ক্রীড়া সাংবাদিকরা যেন শ্যুটিংকে দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করে খেলাটির জনপ্রিয়তায় সরাসরি ভূমিকা রাখেন।

‘আসলে এটা আমাকে অনেক কষ্ট দেয়। যখন দেখি আমাদের সফলতা অনেক বেশি কিন্তু জনপ্রিয়তা তেমন না। নিজেও শ্যুটিংয়ে আসার আগে এসম্পর্কে তেমন জানতাম না। কিন্তু আসার আগেই শ্যুটিংয়ে অনেক অর্জন দেশের জন্য এসেছে। সেগুলো আমার জানা ছিল না। কারণ গণমাধ্যমের ফোকাস তেমন ছিল না। এই খেলাটাকে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় করার জন্য যারা বেশি ভূমিকা রাখতে পারে, গণমাধ্যম। আমরা আমাদের মতো কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের সিনিয়ররা ভালো ফল এনে দিয়েছেন। জুনিয়র যারা আছেন, তারাও ফল দিচ্ছেন। ফলাফলগুলো দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব গণমাধ্যমের। আপনারা যদি গেমটাকে ফোকাস করেন, তাহলে আমরা কষ্ট করে বিদেশ থেকে বিভিন্ন সম্মান নিয়ে আসছি, এটা দেশের মানুষরা জানতে পারবে।’

‘ক্রিকেট-ফুটবলের মতো শ্যুটিং জনপ্রিয় হচ্ছে না সেটার জন্য মিডিয়া দায়ী। কারণ তারা ক্রিকেট-ফুটবল এগুলাকে বেশি ফোকাস করে। একজন ক্রিকেটারের কী হল না হল, সে কোথায় ঘুরতে গেল, তার স্ত্রী নিয়ে কোথায় ঘুরতে গেল, সবকিছু নিয়ে আপনারা নিউজ করছেন। সেখানে একজন আন্তর্জাতিক শ্যুটার কী করছে, কোথায় আছে, কি ফলাফল করল, সেগুলা কিন্তু তেমনভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে না। গণমাধ্যম যদি আমাদের দিকে ফোকাস করে, তাহলে আমাদের অর্জনগুলো দেশের মানুষ জানতে পারবে। আমরা জনপ্রিয় হবো। আমাদের কারণে শ্যুটিং জনপ্রিয় হবে। অর্জনের তুলনায় ফোকাস কম পাওয়া যখন দেখি, তখন কষ্ট পাই। আপনারা যদি নিউজ করেন, ফোকাস করেন, তাহলে জনপ্রিয়তা বাড়বে।’

‘এটা অবশ্য ঠিক ইনডোর গেম হওয়ার কারণে শ্যুটিংয়ের জনপ্রিয়তা কম। ইনডোর গেম হওয়াতে এখানে দর্শক আসে না। যে গেমে দর্শক নাই, সেই গেমের ব্যাপারে মানুষ বেশি জানে না, জনপ্রিয়তা কম। দর্শক না আসার কারণে তারা এব্যাপারে জানে না। গেমটা বোঝে না। তারা যখন জানবে-বুঝবে, আগ্রহ থাকবে, তখন তারা দেখতে আসবে। যখন এসব খবর মানুষের নিউজ ফিডে ঘুরবে, তারা জানতে আগ্রহী হবে। গেমটা কী, কীভাবে খেলে, আচ্ছা এই গেমটা একটু দেখে আসা যাক, এমন ভাবনা আসবে। যখন তারা আসবে, দেখবে, খেলাটার মজা পাবে, তখন আস্তে আস্তে জনপ্রিয়তা পাবে। মানুষ জানে না বিধায় ইনডোর গেমটা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না। যেমন ভারতে ইনডোর গেম হিসেবে শ্যুটিং তেমন জনপ্রিয় ছিল না। যখন অভিনব বিন্দ্রা অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জিতল, তাদের দেশে শ্যুটিং অন্য লেভেলে চলে গেল। এটার কারণ ছিল প্রথমত অলিম্পিকে স্বর্ণ পাওয়াটা অনেক বড় অর্জন। এটার পর থেকে সে দেশের মিডিয়া অনেকবেশি কাজ করেছে। আশা করি আমাদের এরকম বড় সফলতা আসলে আর গণমাধ্যম কাজ করলে ইনডোর গেম হলেও শ্যুটিং জনপ্রিয়তা পাবে।’

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে শ্যুটার গার্ল জানালেন, এয়ার রাইফেল ইভেন্টটাই তার পছন্দ। ভবিষ্যতে ৫০ মিটারের ইভেন্টেও করবেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এটি রপ্ত করতে চালাচ্ছেন প্রশিক্ষণ। জাতীয় পর্যায়ে ৫০ মিটারে অংশ নিতে চান। ক্যারিয়ারে এয়ার রাইফেলে ১০ আর ৫০ মিটারের ইভেন্ট সমানভাবে চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে কলির।

Labaid
BSH
Bellow Post-Green View