এবার ঈদে মুক্তি পেয়েছে নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিমের ‘কাজলরেখা’। লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যের হিরণ্ময় স্মারক ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ অবলম্বনে সিনেমাটি নির্মাণ করা হয়েছে। সিনেমাটি নিয়ে এবার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন সাংবাদিক রুদ্রাক্ষ রহমান। ফেসবুকে ‘কাজলরেখা’ নিয়ে লেখা তার পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো নিচে।
ভালো সিনেমা বানানো, নির্মাণ, তৈরি বা সৃষ্টি করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এটা সবাই পারেন না। যদি মিস্টার চার্লস চ্যাপলিন এখন থাকতেন কোনো সিনেমা পাড়ায়, তাকে খুব আপন ভেবে জানতে চাইতাম তিনি কেনো এতোটা কষ্টের কাজ বেছে নিয়েছিলেন? আর কী করে সেই একশ’ বছরেরও আগে থেকে এমনসব সিনেমা দিলেন দুনিয়াকে যা এখনো তাজ্জব বানিয়ে দেয় সবাইকে। অতশত ভাবার দরকার নেই কেবল মনে করা যাক ’দ্য কিড’ সিনেমার সেই স্বপ্ন দৃশ্যটির কথা। পাখায় ভর দিয়ে উড়ে বেড়ানোর দৃশ্যটি। ১০৩ বছর আগে! অথবা মডার্ন টাইমে অফিস কক্ষে বসে মালিক মনিটরে দেখছেন কারখানার শ্রমিকদের কাজের, ফাঁকির সব চিত্র। ১৯৩৬ সালের সিনেমা! কী করে সম্ভব! একটা বিস্ময়কর মানুষ, বিস্ময় জাগানিয়া স্রষ্টা চার্লস চ্যাপলিন!
তো, তাকে তো আর নাগালে, আপন করে পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া যেতে পারে বাংলা ভাষার এক সিনেমা স্রষ্টা, গিয়াস উদ্দিন সেলিমকে। তিনি ‘মনপুরা’ দিয়ে বাঙালি সিনেমা দর্শকের মন জয় করে নিয়েছেন শুরুতে। এই দেশে ভালো সিনেমার পাঠ অতীত হয়ে যাওয়ার পর, অনেক, অনেক দিন মন্দ সিনেমা শেকড়হীন দাপট দেখিয়ে অনেক। সেই বাজে সময়টাকে হটিয়ে আবার যখন ভালো সিনেমার পথে হাঁটা ধরলো বাংলাদেশ। ঠিক তার প্রথম সিনেমাটা বোধ করি মনপুরা। পরিচালক সফল, সফল বাণিজ্যও। সবচেয়ে সফল বাঙলা সিনেমার ঐতিহ্য গান। মনপুরার গান এখনো বেজে ওঠে, গেয়ে ওঠেন অনেকে। এবং মনপুরা থেকেই গিয়াস উদ্দিন সেলিম সিনেমাপ্রেমি, দর্শক, সমালোচক, অর্থ জোগানদাতাদের কাছে সমীহের জায়গা করে নিয়েছেন। তারা এটা বোঝেন এবং মানেন, গিয়াস উদ্দিন সেলিমের পক্ষে খারাপ সিনেমা করা সম্ভব নয়।
আমি সিনেমা দেখতে ভালোবাসি, সিনেমা নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসি। এবং চাই এই দেশে অনেক, অনেক ভালো সিনেমা হোক। পশ্চিম বাঙলার মহান স্রষ্টাদের বিশ্বজয় করা বাঙলা সিনেমার কথা না হয়, ওপারেই সরিয়ে রাখি। এপারে মহান স্রষ্টা, জহির রায়হান তার ছোট্ট একটা কর্মজীবনে ‘জীবন থেকে নেয়া’র মতো সিনেমা তৈরি করে গেছেন। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলে তার ‘বেহুলা’ সিনেমার সিনেমাটোগ্রাফি চোখ কপালে তুলে দেবে। আলমগীর কবিরের মতো মেধাবী নির্মাতা ছিলেন আমাদের। সালাউদ্দীন জাকির হাত দিয়ে তৈরি হয়েছে ‘ঘুড্ডি’র মতো একটি অত্যন্ত আধুনিক বাঙলা সিনেমা। এসব মাথায় থাকলে, খারাপ সিনেমা বানানোটাই সম্ভব নয়। তাই গিয়াস উদ্দিন সেলিম ভালো সিনেমা বানাচ্ছেন।
আমাদের, বিশ্ব বাঙালির অমূল্য এক সম্পদের নাম ’মৈমনসিংহ গীতিকা’। সেই রত্নভাণ্ডারকে উপজীব্য করে সেলিম এবার নির্মাণ করেছেন ‘কাজল রেখা’। গানে গানে, প্রাণে প্রাণে ভরা একটা সিনেমা। যতক্ষণ পর্দায়, ততক্ষণ চোখ ফেরানো যায় না এমনি তার দৃশ্যায়ন আর টান। মন অন্য কোথায় সরানো যায়নি, এমনি তার সঙ্গীত আয়োজন। এই প্রথমবার ইরেশ যাকেরকে দারুণ অভিনেতা মনে হয়েছে আমার। ঘটনা আর দৃশ্যের সঙ্গে নিজেকে ভাঙা, খাপ খাওয়ানো মুখে এবং শরীরে, খুব ভালো। রাজ আহামরি কিছু করেননি, তবে অসহ্য লাগবে না। বড় হয়ে যিনি কাজল রেখা হোন, তিনি মন্দিরা চক্রবর্তী; সম্ভবত এটাই তার প্রথম সিনেমা, তিনিও ভালো করেছেন। তবে কাজল রেখার ছোটবেলার চরিত্র যিনি করেছেন বনবাসে যাওয়ার আগ পর্যন্ত- সিনেমা হলে বসে বুঝতে পারলাম দর্শক মন তাকে গ্রহণ করেছে একটু বেশি। আর, এই প্রথমবার প্রতিভাধর অভিনয়শিল্পী মিথিলাকে পাওয়া গেলো খল চরিত্রে। কী যে ভালো করেছেন তিনি!
কাজল রেখার প্রতিটি দৃশ্য পরিষ্কার। আজও আমাদের গ্রাম বাংলা, বিশেষ করে ভাটি অঞ্চল যে এতো সুন্দর সেটা আবার গিয়াস উদ্দিন সেলিম তুলে এনেছেন কাজল রেখায়। এই সিনেমায় সেলিম আমাদের অতীত বাংলাদেশের এক গল্প বলতে বলতে সুন্দর এক বাংলাদেশ দেখিয়েছেন। সিনেমা হলে বসে এই বাংলাদেশ দেখলে চোখ, মন কখনো ক্লান্ত হবে না। শহরের প্রযুক্তি সমৃদ্ধ সিনেমা হলে, অনেকগুলো টাকা দিয়ে টিকিট কেটে, সিনেমাটা দেখতে গিয়ে একবারও মনে হবে না, ’যা ঠকে গেলাম’।
ধন্যবাদ মিস্টার গিয়াস উদ্দিন সেলিম। আমি সিনেমা খুব বুঝি না। বানাতে তো পারবোই না! তবে সিনেমাপ্রেম প্রবল। সেই প্রেম থেকে বলি, চাই শহরের পপকর্নের গন্ধমাখা হলগুলোতে নয় কেবল, এই সিনেমা ছড়িয়ে যাক প্রতিটি জেলা, উপজেলা শহরে। কাজল রেখার গানে গানে নেচে উঠুক সব সিনেমা হল। আর দেশ ছাড়িয়ে চলে যাক সাত সমুদ্র শত নদীর ওপারে। বিশ্ব বাঙালির সঙ্গে বিদেশিরাও দেখুক কাজল রেখা। দেখুক, এই পোড়া, দুঃখী সময়েও কতো সুন্দর বাংলাদেশ।