দখল দূষণের পাশাপাশি নদী থেকে বালু-পাথর উত্তোলন এখন সহ্যের বাইরে চলে গিয়েছে। উচ্চ আদালতের রায় থাকা সত্ত্বেও সরকার তা বাস্তবায়ন করছে না। কেবল দৃশ্যমান উন্নয়ন নয়, দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য নদ-নদী রক্ষা করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব বলে মন্তব্য করেছেন বেলার নির্বাহী প্রধান ও পরিবেশবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
সোমবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে “বালু-পাথর উত্তোলন ও দখল-দূষণে নদ-নদীর বিদ্যমান জীর্নদশা এবং পরিবেশ সংকট” বিষয়ক একটি গোলটেবিল আলোচনায় উক্ত কথাগুলো তিনি বলেছেন।
বিশ্ব নদী দিবস- ২০২২ পালন উপলক্ষে জাতীয় পর্যায়ে কর্মরত ৭ টি অধিকার ভিত্তিক বেসরকারি সংস্থার (বেলা, নিজেরা করি, এএলআরডি, নাগরিক উদ্যোগ, সিসিডিবি, ইনসিডিন বাংলাদেশ, এবং বিএনপিএস) সমন্বয়ে গঠিত পানি অধিকার ফোরাম (ডজঋ), এএলআরডি ও বেলা’র যৌথ উদ্যোগে এ আলোচনা সভাটি আয়োজিত হয়।
বাংলাদেশের নদ-নদী থেকে বালু পাথর উত্তোলনের সার্বিক চিত্র ও আইনী দিক নিয়ে বিষয়ভিত্তিক একটি উপস্থাপন দেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। উপস্থাপনায় তিনি বলেন, “উন্নয়নের জন্য আমরা ট্যানারী আরও তৈরি করতে পারবো, কিন্তু একটি বুড়িগঙ্গা বা ধলেশ্বরী আমরা তৈরি করতে পারবো না”। তিনি আরও বলেন যে কৃষি নির্ভর বাংলাদেশে সেচের জন্য প্রয়োজনীয় পানির ২৫ শতাংশ নদী ও অন্যান্য জলাশয় থেকে পাওয়া যায়। ভূমি মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন জেলার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ২০২১-২২ সালে বালু মহালের সংখ্যা ৩০৬টি এবং ইজারাকৃত বালুমহালের সংখ্যা ২৫৬টি। ইজারাকৃত বালু মহাল থেকে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ২৩৫ কোটি ৫৬ লাখ ৫৯ হাজার ২৮ টাকা। অথচ, যারা এ ব্যাবসার সাথে যুক্ত তারা আরও বেশি আয় করছে। বালু-পাথর উত্তোলনের জন্য ১২০ থেকে ১৩০ ফুট গর্ত করার কারণে আশেপাশের ঘরবাড়ি, কৃষিজমি ও অন্যান্য স্থাপনা ধ্বসে পড়ছে। তিনি আরও বলেন, বালুর চাহিদা বেড়েই চলেছে, কিন্তু এই চাহিদা কিভাবে মেটাবে সেই পরিকল্পনা সরকারের নেই। পার্শবর্তী দেশ ভারতে ৫ একরের বেশি বালু মহাল থাকলে সেখানে পরিবেশগত প্রভাব নিরূপন করতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে বাস্তবে ৫ একর হলে তা আরও কমিয়ে দেখানো হয় কাগজে কলমে। সবশেষে তিনি বলেন পরিবেশ উন্নয়নের কাছে মাথা নত করবে না, উন্নয়নকে পরিবেশের কাছে মাথা নত করতে হবে।
জাকির হোসেন, প্রধান নির্বাহী, নাগরিক উদ্যোগ বলেন, আমাদের কর্মকা- নদী বিরোধী। অর্থনৈতিক বিবেচনায় আমরা পরিবেশ তথা নদ-নদীর অনেক বেশি ক্ষতি করছি। আমাদের আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো থাকলেও নদী সুরক্ষায় প্রকৃত উদ্যোগ গ্রহণ করছে না।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ বলেন, লালমনিরহাটে তিস্তা ব্যারেজের কাছেই বালু উত্তোলনের ফলে ৩২ শত একর ধানী জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। “নদী দখলদারদের শাস্তি নিশ্চিত ও ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে”, তিনি বলেন।
বরেন্দ্র অঞ্চলের নদী আন্দোলনের সাথে যুক্ত উন্নয়নকর্মী আফজাল হোসেন বলেন, রাজশাহীর খিদিরপুরে বালু পদ্মা নদী থেকে বালু উত্তোলনের ফলে ধানী জমি ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদী পাড়ের মানুষদের সংগঠিত করে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
চট্টগ্রামের সাংবাদিক অলিউর রহমান বলেন যে কর্নফুলী কালুরঘাট এলাকায় একশটির বেশি ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ড্রেজার মেশিনের সাথে ধাক্কা খেয়ে হালদা নদীর ডলফিনগুলো মারা যাচ্ছে। এ বছর হালদা নদীতে মা মাছ কোন ডিম ছাড়েনি। হালদা নদীর মোহনায় নোয়াপাড়া এলাকায় প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার বালু উত্তোলন করা হয়।
আলোচনার সভাপতি এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা সমাপনী বক্তব্যে বলেন, এসডিজি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নদ-নদী-পরিবেশ সুরক্ষা, প্রান্তিক মানুষের অধিকার রক্ষার মাধ্যমে এনজিওগুলো সরকারকে সহযোগিতায় কাজ করছে। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে সরকার কর্তৃক নানাবিধ আইন প্রণয়ন ও পরিপত্র জারির ফলে এনজিও-দের কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। যা এসডিজি পূরণের পথকে আরও অমসৃণ করে তুলছে। নদ-নদী রক্ষায় আমাদের ঐক্যবদ্ধ, গতিশীল ও সক্রিয় হতে হবে।
এছাড়াও, আলোচনায় দেশের ৮ বিভাগ থেকে তৃণমূলের বিভিন্ন সংস্থা এবং নদী রক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গ ও সাংবাদিকবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।