গ্রামের একটা প্রবাদ আছে, ‘ভাশুরের নাম মুখে নিলে পাপ।’ আজকাল বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজ ঘুষখোরদের ক্ষেত্রে এ প্রবাদটা বেশ প্রযোজ্য। দুর্নীতিবাজ বা ঘুষখোরদের নিয়ে কথা বললেই মনে হয় মহাপাপ করে ফেলেছে। অথচ বিশ্বের মোড়ল দেশ যখন বাংলাদেশের প্রশাসন থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যক্তিদের নিয়ে কথা বলছে তা নিয়ে শক্তভাবে অবস্থান নিতে পারে না সরকার ও সে সকল প্রতিষ্ঠান, যারা এদের দুর্নীতিকে নীরবে সয়ে গেছে বা সয়ে যাচ্ছে। যদিও সরকার দলের নেতারা তাদের বক্তব্যে হালকাভাবে মানুষকে সান্ত্বনার বাণী দিয়ে বলেন, এসব ভুয়া মিথ্যা তথ্য। আর সাবেকদের নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা কম তা আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান আজিজ আহমেদের ওপর মার্কিনিদের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে যুক্তি খণ্ডের বা আলাপচারিতা চলার মাঝেই দুদুকের মামলায় পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদের সম্পত্তি ও ব্যাংক হিসাব জব্দ করার নির্দেশ দিয়ে আদালতে নতুন চমক দিলেন। ঘটনাটা পুরনো আর এ বিষয়ে বেনজির আহমেদ বলেছিলেন, “তার কোন সম্পত্তি অবৈধ নয়। যদি কেউ প্রমাণ করতে পারে তার সম্পত্তি অবৈধ, তবে সে গ্রুপ বা ব্যক্তিকে বিনামূল্যে সম্পত্তি দিয়ে দিবে।” এধরনের কথায় দুদুকের মামলা ক্ষেত্রে একটা সংশয় থেকে যায় আর তা হলো, দুদুক মামলার স্বপক্ষে যথাযথ প্রমাণ ও সাক্ষ্য প্রধান করতে পারে কিনা? সাধারণত দুদুকের মামলা পরিচালনা বা রায় কার্যকর করা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে জনমনে। আদালত অঙ্গনে দুদুকের মামলার নয়ছয় কোন গোপন বিষয় নয়। আবার অনেক সময় বলা হয়,’দুদুকের মামলা মানে অবৈধ টাকাকে বৈধ করার সুবর্ণ সুযোগ।’
আজিজ আহমেদ বা বেনজির আহমেদে বাংলাদেশের জন্য কোন একক উদাহরণ নয়। এ ধরনের রাঘব বোয়ালদের সংখ্যা দেশের প্রতিটি সেক্টরে অগণিত। আর এদের কাছে জিম্মি দেশের জনগণ ও সরকার। কেন জিম্মি তার উত্তর যেমন মানুষ জানে তেমনি সরকারও অবগত। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে শেখ হাসিনার সরকার দুর্নীতি দমন করতে পারেনি। এ নীতি কেবলমাত্র প্রধানমন্ত্রীর একক নীতি হিসেবে প্রতীয়মান হয় মানুষের কাছে। আর কারো কাছে এ নীতির আর্দশবোধ আছে বলে মনে হয় না।
গণতান্ত্রিক দেশের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা গণতন্ত্রকে যেমন দুর্বল করে তেমনিভাবে জনগণের সমর্থনকে উপেক্ষা করে প্রশাসন নির্ভর হয়ে দেশ চালাতে হয় সরকারকে। আর তখনি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সরকারকে জিম্মি করে তাদের ফায়দা লুটে নেয়।এ সত্যটা রাতের তারার মত সত্য হলেও স্বীকার করতে পারে না রাষ্ট্র ব্যবস্থা। কারণ বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক সরকার প্রধান এসব প্রতিবন্ধকতা ভেঙে দিয়ে সোনার বাংলার গড়ার স্বপ্ন দেখেন বলেই তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তার স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে।
তবে উন্নয়নের পথে হাঁটতে গিয়ে মানবিক উন্নয়ন না করে শুধুমাত্র ইট-পাথরের উন্নয়নকে প্রাধান্য দিলে তা কখনোই টেকসই হয় না। তার প্রমাণ বোধ করি বর্তমানের বাংলাদেশে। যার কিছু জলন্ত উদাহরণ রয়েছে সমসাময়িক কালে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন নিয়ে খুব হৈচৈ রয়েছে দেশে। সিঙ্গাপুর, আমেরিকার সাথে তুলনা করা হয় দেশের রাস্তা ঘাটকে।কিন্তু এ উন্নয়ন যে কতটা ক্ষণস্থায়ী তার প্রমাণ মিলে যখন এবারের গরমে রাস্তার পীচ ফেটে চৌচির হয়ে যায়- তখনই।
বলা হয়েছিল রাস্তায় যে বিটুমিন ব্যবহার করা হয়েছে তা মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোর গরমেও নষ্ট হবে না। অথচ বাস্তবের চিত্র বলেছে ভিন্ন কথা। একাজে দুর্নীতি ছিল বলেই উন্নয়নের নামে অসাধু ব্যক্তি ফায়দা নিয়ে সরকারকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। কোটি কোটি টাকা উন্নয়নের নামে হাতিয়ে নিচ্ছে দেশের রাস্তা ঘাট ও রেলসহ নানা প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বাংলাদেশের রেল ব্যবস্থাপনার চিত্র কতটা তথৈবচ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। স্টেশনের টিকেট নিয়ে কালোবাজারি, রেলের যন্ত্রপাতি কেনা, রেললাইনের উন্নয়ন স্টেশনের আশেপাশে অবৈধ স্থাপনা থেকে চাঁদাবাজিসহ রেল সম্পদের দখলবাজিতে সম্পৃক্ত রয়েছে রেলের সকল শ্রেণির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। টিকেটের কালোবাজির বন্ধ করতে মেশিনে টিকেট সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু হলেও মেশিন প্রায় বিকল থাকে। কালোবাজারিরা সেনা সদস্যকে হেনস্তা করেছে তা এ সিন্ডিকেটের বিশেষ উদাহরণ। অন্যান্য সেক্টরের মত এ সেক্টরেও রয়েছে সিন্ডিকেট। আর এ সিন্ডিকেটের সদস্যরা একই স্টেশনে কাজ করে বছরের পর বছর। তাদের বদলি করার সাহস হয় না কারো। কারণ এদের হাত বেশ লম্বা। ঠিক একই অবস্থা দেশের বন্দর জাহাজ সেক্টরে। অথচ এক সময়ে বাংলাদেশের রেল ও শিপিং ছিল উল্লেখযোগ্য লাভজনক প্রতিষ্ঠান। অথচ চট্রগ্রাম বন্দরের শ্রমিক রাজনীতি ক্ষমতার অপব্যবহারের ধ্বংস করেছে এ সেক্টরকে।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি নিয়ে জনগণ আতঙ্কিত দীর্ঘ সময় ধরে। ব্যাংক লুটেরাদের নামের দীর্ঘ তালিকা তৈরি হচ্ছে সময়ের পরিক্রমায়। তবে তাদের থেকে অর্থ ফেরত পাবার প্রক্রিয়া সেই আইনের মারপ্যাঁচ ঘুরপাক খাচ্ছে দিনের পর দিন। সমাধান হিসেবে অলাভজনক ব্যাংকে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে স্থিতিশীল ব্যাংকের ঘাড়ে। যার ফলাফল হিসেবে জনগণ আস্থা হারাচ্ছে দেশের ব্যাংক সেক্টরের ওপর। এখানেই ক্ষান্ত নয় দুর্নীতিবাজরা। তাদের এসব অপকর্মের কাছে জিম্মি শুধু জনগণ নয়, সরকার ও বেকাদায় পড়ছে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে সামাল দিতে গিয়ে ।
রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতা শব্দগুলো এখন কেবল কাগজে কলমের ভাষা। জনগণের কথা বলার রাজনীতিবিদের বড় অভাব দেশে। ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক নেতা হবার খায়েশের কারণে সঠিক রাজনৈতিক নেতা তৈরি হচ্ছে না সমাজে। যার প্রামণ মিলে যখন প্রধানমন্ত্রী বলেন, “১১বছরে দলের ১১হাজার কর্মী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কেন এরা দল থেকে দুরে সরে গেলো, এর জবাব আওয়ামী লীগের নেতাদের অবশ্যই দিতে হবে।” এ কথা কতটা দু:খজনক তা বুঝতে পারলে স্থানীয় নেতারা নিজেদের জবাবদিহিতার বন্দোবস্ত করতে পারত। তারা তা করতে পারে না। কারণ রাজনীতি এখন ব্যবসাতে পরিণত হয়েছে। তাই আর্দশ নেতা ও কর্মীদের হটিয়ে যারা জয় বাংলার লেবাস ধরে আছে তারা দু:সময়ের বন্ধু হবে না এটা যে অবধারিত সত্য তা জেনেও চুপ থাকে দলের নেতারা।
তাই আওয়ামী লীগের সমর্থনকারীদের আজকাল বলতে শুনা যায়, “আওয়ামী লীগ ছাড়া দেশে আর কোন দল নাই। তাদের দল ক্ষমতায় থাকবেই, অতএব নিজেদের অর্থ সম্পদ তৈরি করে আখের গোছানোর এটাই উপযুক্ত সময়।” এ ধরনের চিন্তা ভাবনায় সত্যিকারের নেতা কর্মীরা নিজেদের আর্দশ হারিয়ে যাবার ভয়ে নীরব অবস্থান নিয়েছে বলে কর্মীরা হারিয়ে যাচ্ছে কালের ধারায়। অন্যদিকে ত্যাগী নেতাদের চেয়ে নব্য ব্যবসায়ী ক্ষমতাধর নেতাদের দৌরাত্ম সবখানেই বেশি। এদের সাথে সম্পর্ক রেখে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা মানবিক উন্নয়নের অন্তরায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মোটকথায় বাংলাদেশের এমন কোন সেক্টর নেই যেখানে ঘুষখোর দুর্নীতিবাজদের প্রভাব নেই। তাই একজন আজিজ আহমেদ বা বেনজির আহমেদের ঘটনা নিয়ে এখন আর বিস্মিত হবার কিছু নেই। বরং যারা ক্ষমতার অপব্যবহার, অবৈধ সম্পদ অর্জন আর টাকা পাচার করে আজ দেশকে হুমকির মুখে ফেলছে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে সবাইকে। এ সাহসটুকু না থাকলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সামনে দাঁড়াতে পারবে না দেশের মানুষ। সামান্যতম দেশপ্রেম থাকলে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে হবে পরিবার ও সমাজকে। তা না হলে আগামী প্রজন্ম দায়ী করবে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে থাকা পরিবার, সমাজ ও দেশকে।