আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন: یُّؤۡتِی الۡحِکۡمَۃَ مَنۡ یَّشَآءُ ۚ وَ مَنۡ یُّؤۡتَ الۡحِکۡمَۃَ فَقَدۡ اُوۡتِیَ خَیۡرًا کَثِیۡرًا ؕ অর্থ্যাৎ আল্লাহ যাকে চান হিকমত প্রদান করেন এবং যে হেকমত পেয়েছে, সে প্রভূত কল্যাণ প্রাপ্ত হয়েছে। সুরা বাকারা, ২: ২৬৯
কুরআনুল কারিম প্রত্যক মুসলমানের জীবন-যাপনের সংবিধান। এই সংবিধানে হেকমতকে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মানব কল্যাণের সাথে। হেকমা মূলত আল্লাহ রব্বুল আলামিনেরই একটি গুণ। আল্লাহর এই গুণ যখন মানবজীবনে আসে, তখন কেবল মানুষ নিজে নয়, পুরো সমাজ এমনকি পুরো জাতি আলোর সন্ধান পায়।
হেকমত শব্দের বাংলা অর্থ প্রজ্ঞা, দর্শন, কোনো কিছু সম্বন্ধে গভীর পর্যবেক্ষণপূর্বক জ্ঞান। হিকমা শব্দটির মূল ধাতু- হা কাফ মিম (ح ك م); এগুলো দিয়ে তৈরি এই শব্দ পুরো কুরআনে ২১০ বার এসেছে। আরবিতে প্রবাদ আছে- হাকিমের কোনো কাজই হেকমতের বাইরে না। আর আল্লাহ তো হাকিমদেরও হাকিম।
অতএব, কুরআন মজিদে এতবার হেকমতের কথা বলারও একটা বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। হেকমতের গুরুত্বের ব্যাপারে আল্লাহ এটাও জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি সবাইকে হেকমত দেন না, যাকে চান তাকেই দান করেন।
হেকমত এমন একটি বিষয় যা দ্বারা ব্যক্তি প্রভুর ইচ্ছা সম্পর্কে জানতে পারে। বুঝতে পারে আল্লাহর কথার গূঢ় রহস্য। কুরআন ও হাদিসে আজকের দিনের সকল সমস্যার সমাধান আছে, তবে সেটা তারাই বের করতে পারেন, যাদের কাছে ইলম আছে এবং ইলমকে ব্যবহার করার মতো হেকমত আছে।
বান্দা যখন হেকমত প্রাপ্ত হয়, তখন কুরআন মজিদে বর্ণিত হালাল-হারাম দিয়েই দুনিয়ার প্রতিটি কর্মকে আল্লাহর ইচ্ছার ভিত্তিতে মেপে নিতে পারে। এজন্যই যুগযুগ ধরে যে কারণে মানুষ সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং সম্মানিত হয়েছে, তা হলো হেকমত।
হেকমত কত বড়ো নেয়ামত এটা বুঝা যায়, হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম’র দু’আ থেকে। তিনি হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামকে সাথে নিয়ে মানবজাতিকে হেকমত শিক্ষা দেওয়ার জন্য একজন রসুল প্রেরণ করার জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করেন- رَبَّنَا وَ ابۡعَثۡ فِیۡهِمۡ رَسُوۡلًا مِّنۡهُمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡهِمۡ اٰیٰتِکَ وَ یُعَلِّمُهُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ وَ یُزَکِّیۡهِمۡ ؕ
অনুবাদ- হে আমাদের রব, তাদের মধ্য থেকে তাদের জন্য একজন রসুল প্রেরণ করুন, যিনি আপনার আয়াতসমূহ তাদের নিকট তেলাওয়াত করবেন এবং তাদেরকে আপনার কিতাব এবং হেকমত শিক্ষা দেবেন। সুরা বাকারা, ২:১২৯
এই দু’আ স্বরূপ আমরা সামনে পাই হাবিবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লামের আলোকিত সত্তা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করছেন-
کَمَاۤ اَرۡسَلۡنَا فِیۡکُمۡ رَسُوۡلًا مِّنۡکُمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡکُمۡ اٰیٰتِنَا وَ یُزَکِّیۡکُمۡ وَ یُعَلِّمُکُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ وَ یُعَلِّمُکُمۡ مَّا لَمۡ تَکُوۡنُوۡا تَعۡلَمُوۡنَ
অনুবাদ- যেমন আমি তোমাদের মধ্যে প্রেরণ করেছি একজন রসুল তোমাদের মধ্য থেকে, যিনি তোমাদের উপর আমার আয়াতগুলো তেলাওয়াত করেন, তোমাদেরকে পবিত্র করেন এবং কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেন। আর তোমাদের ওই শিক্ষা দান করেন, যার জ্ঞান তোমাদের ছিল না। সুরা বাকারা, ২:১৫১
হেকমত কত গুরুত্বপূর্ণ তা এখানেও বুঝা যায় যে, উক্ত দুই আয়াতেই আল-কিতাব তথা কুরআনুল কারিমের সাথে হেকমতের আলোচনা উঠে এসেছে। এই হেকমতই নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লামের চরিত্রকে করেছে আরও সুউজ্জ্বল।
অনেকেই মনে করেন, হেকমত বলতে কেবল সুন্নাহকেই বুঝানো হয়েছে, আবার অনেক মুফাসসিরদের মতে, হেকমত দ্বারা বুঝানো হয়েছে, আল্লাহর হাবিব শিক্ষা দেবেন কীভাবে প্রতিটা কাজে আল্লাহর ইচ্ছা বুঝতে পারার দক্ষতা অর্জন করতে হয়। উদাহরণ স্বরূপ একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়-
একবার এক বেদুঈন মসজিদে নববি শরিফে প্রবেশ করল, সেই সময় রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামদের নিয়ে মসজিদে বসে ছিলেন। বেদুঈনটি এসেই মসজিদের এক পাশে প্রস্রাব করে দিল। এই কাজ দেখে সাহাবাগণ রাগ করে তেড়ে গেল বেদুঈনের দিকে। ধমক দিতে লাগল। কিন্তু নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আল্লাহ পাঠিয়েছেন হেকমত শেখাতে। তাই হেকমত প্রদর্শনপূর্বক আল্লাহর হাবিব লোকটিকে প্রস্রাব করতে বাধা দিলেন না, উলটো সাহাবাদের বলছেন, তাকে ধমক না দিতে। বেদুঈন লোকটি প্রস্রাব শেষ করলে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে নির্দেশ দিলেন- লোকটির প্রস্রাবের উপর এক বালতি পানি ঢেলে দাও। এতে মসজিদ থেকে ময়লাও দূর হলো এবং পবিত্র হয়ে গেল।
এরপর বেদুঈন লোকটিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম নিজের কাছে ডাকলেন এবং বললেন- إِنَّ هَذِهِ الْمَسَاجِدَ لَا تَصْلُحُ لِشَيْءٍ مِنْ هَذَا الْبَوْلِ، وَلَا الْقَذَرِ إِنَّمَا هِيَ لِذِكْرِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَالصَّلَاةِ وَقِرَاءَةِ الْقُرْآنِ – অর্থ্যাৎ মসজিদসমূহে প্রস্রাব ও অপবিত্র কোনো কাজ করা জায়িয না। বরং এটা শুধু আল্লাহর যিকর, নামাজ ও কুরআন পাঠের জন্য। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লামের এ সুন্দর আচরণ লোকটির হৃদয় গলে গেল। সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর- ৬০২৫
এজন্যই কোনো কোনো রেওয়ায়েতে আছে বেদুঈন এমন কথা শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে বলল- اللهم ارحمني ومحمداً ولا ترحم معنا أحداً- ইয়া আল্লাহ, আমাকে এবং মুহাম্মদকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) দয়া করো, আমাদের সাথে কাউকে দয়া করো না।
হেকমতের কী চমৎকার দৃষ্টান্ত! এটাকেই মাওলানা রুমি রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন- چند خوانی حکمت یونانیاں حکمت ایمانیاں را ہم بخواں
চান্দ খোয়ানি হেকমত-এ ইউনানীয়াঁ
হেকমাতে ইমানী রা হাম বাখাওয়াঁ
অর্থাৎ, তোমরা কতদিন ইউনানি হেকমত শিখতে বুঁদ হয়ে থাকবে, কখনও তো কুরআনের হেকমত এবং ইমানের হেকমত পড়ার সুযোগ করো।
কুরআনে পাক এবং আল্লাহর হাবিবের জীবন-কর্মে আল্লাহ তাআলা সকল হেকমত একত্র করে দিয়েছেন। আল্লাহ ইরশাদ করেন- হে হাবিব, এই কথাগুলো ওই হেকমতের অর্ন্তভুক্ত যা আপনার প্রভুর আপনার ওপর নাযিল করেছেন।
কুরআন শরিফে হেকমত প্রাপ্তদের মধ্যে হযরত লোকমানের নামটি আমরা খুঁজে পাই। কারো মতে তিনি নবি ছিলেন, তো অনেকের মত ছিল তিনি ছিলেন স্বীয় যুগের একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি। গোলাম হয়েও মালিকের কাছে প্রাণাধিক প্রিয় হয়ে উঠেন তিনি। যার প্রজ্ঞার উপমা পুরো আরবে প্রসিদ্ধ ছিল। আর এই প্রজ্ঞার কারণেই তার নাম কুরআনে আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেছেন।
আজকের দিনে তো আমাদের অবস্থা এমন যে, আমরা হেকমতকে কোনো এক অদ্ভুত বক্সে বন্ধ করে বসে আছি। যা শিখি, কুরআন ও সুন্নাহ থেকে শিখি না। অথচ হেকমতের ভান্ডার এখানেই। এই হেকমতের জোরেই সাহাবাগণ ইসলামকে সমুন্নত করেছিলেন। ইতিহাসের স্বর্ণযুগ তৈরি করেছেন। এই হেকমত ব্যবহার করেই মুসলমানগণ বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানের জোয়ার সৃষ্টি করেছেন। আজও সেই হেকমত আছে, তবে ব্যবহার করার মতো ইনসান-এ কামেল নেই।
সহজভাবে বলতে গেলে- হেকমত বা প্রজ্ঞা হলো একটি পুরস্কার; যা আল্লাহ তার মুহসিন বা সৎকর্মশীল বান্দাদের দান করেন। আল্লাহর উদ্দেশ্য বুঝে তারাও নিজেকে তো উন্নত করেনই, মানব সমাজকেও করে আলোকিত ও সম্মানিত। এজন্যই আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- হেকমত যে পেয়েছে, সে প্রভূত কল্যাণ প্রাপ্ত হয়েছে। জীবনের প্রতি ধাপে আল্লাহ আমাদের সবাইকে তার হেকমত বুঝার তৌফিক দান করুন।