চলতি বছরের শুরু থেকেই যেন নিত্যপণ্যের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিদ্যুতের দাম। ১২ জানুয়ারি বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির পর ফেব্রুয়ারি শেষ না হতেই তিন ধাপে বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের মূল্য। যার ফলে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে সাধারণ মানুষের। তারা বলছেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি দেখিয়ে রমজান মাসে তিনগুণ বেশি দাম রাখবে ব্যবসায়ীরা।
নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে নাভিশ্বাস সাধারণ মানুষের। এর মধ্যে গত দুই মাসে তিনবার বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি সবার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষরা আর্থিক সঙ্কটে পড়বেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সর্বশেষ ২৮ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার দেশে বিদ্যুতের দাম খুচরা পর্যায়ে ৫ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। এর আগে, গত ৩১ জানুয়ারি সরকারের নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম পাইকারি পর্যায়ে ৮ শতাংশ এবং গ্রাহক পর্যায়ে ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। তার আগে ১২ জানুয়ারি ভোক্তাপর্যায়ে বিদ্যুতের খুচরা দাম গড়ে প্রতি ইউনিটে ৫ শতাংশ বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার।
বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির খবরে সবাই, বিশেষত সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন। কারণ বিদ্যুতের দাম বাড়লে খরচ বাড়বে কৃষি, শিল্প উৎপাদন ও সেবা খাতে। ফলে আরেক দফা বাড়বে দ্রব্যমূল্য। ক্ষতিগ্রস্ত হবে রপ্তানি খাত। করোনা মহামারীর পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে মানুষ, বিশেষ করে দেশের শিল্পখাত।
এ অবস্থায় পাইকারি পর্যায়ে দাম বৃদ্ধির পর গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে সংকটে পড়বে এই খাত। চাপ বাড়বে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর। বৈশ্বিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে অর্থনৈতিক সংকট এখন প্রকট। সেক্ষেত্রে এই খাতে সরকারের ভর্তুকি অব্যাহত রাখা উচিত ছিল বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
নিউমার্কেট এলাকার অধিকাংশ ব্যবসায়ী বলছেন, চলমান বৈশ্বিক সংকটময় মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ঠিক হয়নি। এতে পোশাকশিল্পসহ শিল্প খাতের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জিনিসপত্র মূল্য বৃদ্ধির ফলে এমনিতেই পরিবারের দৈনিক চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে উল্লেখ করে ব্যবসায়ী মামুনুর রশীদ বলেন, প্রতিটি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। শাক-সবজি থেকে শুরু করে মাছ-মাংস কিংবা কাপড় দাম বৃদ্ধি হয়নি কোথায়! গত ২ মাসে যেভাবে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে আবারও জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। আর আমাদের মতো ব্যবসায়ীরা ব্যবসা গুটিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে৷
অন্যদিকে রমজানের পূর্ব মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি নিয়ে বেশ চিন্তিত সাধারণ মানুষ। একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন নাজমুস সাকিব। তিনি বলেন, এমনিতেই সব পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে নিয়মিত-ই। কিছুদিন পর রমজান। এই মাসকে পুঁজি করে ব্যবসায়ীরা অধিক মূল্যে জিনিসপত্র বিক্রি করে। এমন সময় বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হলো, এতে তাদেরকে বড় ধরনের সুযোগ তৈরী করে দিল। তারা এখন ৫ টাকার জিনিস ১৫ টাকা বিক্রি করতেও চিন্তা করবে না। কারণ হিসেবে বিদ্যুৎ, গ্যাসের দাম বৃদ্ধিকে সামনে নিয়ে আসবে।
মুসা ইবরাহিম নামের এক ভোক্তা জানান, যা বেতন পান তা দিয়ে আগে মোটামুটিভাবে সংসার চালাতে পারলেও বর্তমানে সব রকমের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশচুম্বী বেড়ে যাওয়ায় সংসার নিয়ে ঢাকাতে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, বাজারে সবকিছুর দাম বেশি তার মাঝে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে কিন্তু আমাদের ইনকাম বাড়েনি। কিছুদিন পরপর বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ে আমরা মানি না, সমন্বয়ের নামে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি আমরা মানি না। সরকারকে বলব বিদ্যুতের দাম কমানো হোক।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির জন্য আয়োজিত সেমিনারে আমরা ভোক্তাদের বিষয়ে কথা বলেছি। আমরা সরকারকে হিসাব করে দেখিয়েছি বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রয়োজন নেই। বিইআরসি যে হিসেব দেখিয়ে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে তা শুধুমাত্র লুণ্ঠন আর অযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। এর বাইরে আর কিছুই না।
দেশের প্রতিটি খাতে এর একটা প্রভাব পড়বে উল্লেখ করে তিনি বলেন, খুচরা ব্যবসায়ী থেকে পাইকারী ব্যবসায়ী সবাই এর সুযোগ নিবে। আর সাধারণ মানুষের অবস্থা ভয়াবহ রুপ ধারণ করবে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি দেখিয়ে আসন্ন রমজানে কয়েক গুণ বেশি দামে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নির্ধারণ করবে ব্যবসায়ীরা।
এছাড়াও তিনি আশঙ্কা করছেন, দেশের শিল্পখাতে এর একটা বড় প্রভাব পড়বে। এভাবে একের পর এক মূল্য বৃদ্ধি হতে থাকলে অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাবে বলেও শঙ্কা করছেন শামসুল আলম। চলমান সংকটকালে সব মহলের আপত্তি সত্ত্বেও গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়াল সরকার।
উল্লেখ্য, আগে দাম বাড়ানোর ক্ষমতা ছিল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) হাতে। এ ক্ষমতা নিজের হাতে নিতে সরকার গত বছর ১ ডিসেম্বর বিইআরসি আইন সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারি করে।
সবশেষ ২৮ ফেব্রুয়ারি এই দফায় ৫ ভাগ দাম বাড়ায় সব মিলিয়ে চলতি বছরের দুই মাসে সরকার ১৫ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে।
মঙ্গলবার বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে এই সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। বর্ধিত মূল্য মার্চ থেকে কার্যকর হবে। এর আগে গত ৩১ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগ পাইকারি ও খুচরা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওই দাম ফেব্রুয়ারি থেকেই কার্যকর হয় হয়। তারও আগে ১২ জানুয়ারি নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
এর আগে বিইআরসি গত বছরের ২১ নভেম্বর বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ায়। তখন ইউনিট প্রতি ৫.১৭ টাকা থেকে এক লাফে গড়ে ১৯.৯২ শতাংশ বাড়িয়ে ৬.২০ টাকা দাম নির্ধারণ করে।