বসন্ত এলে যেমন বৃক্ষরাজি শুকনো মর্মর পল্লবরাজি ঝেড়ে নবপল্লবে সজ্জিত হয়, শীতের তীব্রতা অতিক্রান্ত হয়ে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া বিরাজ করে, দখিনা মৃদুমধুর সমীর নিত্য নিত্য শীতল পরশ বুলিয়ে যায়, তেমনি রমজান আসে অতীতের যাবতীয় জঞ্জাল ধুয়েমুছে সাফ করার প্রত্যয়ে ইবাদতের স্নিগ্ধ পরশ নিয়ে। তাই রমজানকে বলা হয়ে থাকে “ইবাদতের বসন্ত।” ফরজ ইবাদতের পাশাপাশি এ মাসে অত্যধিক নফল ইবাদতের আবহ বিরাজ করে মুসলিম সমাজে। করবে নাই বা কেন, প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে নিজেই উদ্বুদ্ধ করেছেন এ ব্যাপারে৷ বায়হাকির হাদিসে এসেছে, “এ মাসের নফল ইবাদত অন্য মাসের ফরজের সমান।”
নফল ইবাদতের গুরুত্ব সম্পর্কে সবচেয়ে আলোচিত হাদিসটি হলো, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আমি যা আমার বান্দার উপর ফরজ করেছি শুধু তা দ্বারাই কেউ আমার নৈকট্য লাভ করবে না, বরং আমার বান্দা সর্বদা নফল ইবাদত দ্বারা আমার অধিক নৈকট্য লাভ করতে থাকবে। এমনকি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয় পাত্র বানিয়ে নিই যে, আমিই তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শুনে। আমিই তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে। আর আমিই তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে। আমিই তার পা হয়ে যাই, যা দ্বারা সে চলে। সে যদি আমার কাছে কোনো কিছু চায়, তবে আমি নিশ্চয় তাকে তা দান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তবে অবশ্যই আমি তাকে আশ্রয় দিই।” (অংশবিশেষ, বুখারি শরিফ)
নফল ইবাদত এমন গুরুত্বপূর্ণ বলেই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসের নির্দিষ্ট অনুসঙ্গের বাইরেও নফল ইবাদতে অধিক মনোযোগী হতেন। হাদিসে পাকে এসেছে, ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা। রমজানে যখন জিবরাইল (আ.) তার সাথে সাক্ষাৎ করতেন, তিনি তখন আরও বেশি দানশীল হয়ে যেতেন। কেননা রমজানের প্রতি রাতেই জিবরাইল (আ.) তার সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তারা পরস্পর কুরআন তিলাওয়াত করে শোনাতেন। নিশ্চয় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রহমতের বাতাস থেকেও অধিক দানশীল ছিলেন। (বুখারি শরিফ, হাদিস নং ০৬)
কেবল দানশীলতাই নয়, রাতজেগে নবীজি ইবাদতে মশগুল হতেন। যেমন শেষ দশকের ইবাদতের তীব্রতার দরুণ তিনি লুঙ্গিতে শক্ত গিট দিতেন এবং পরিবার-পরিজনকেও ইবাদত করার তাগাদা দিতেন বলে বর্ণনা এসেছে। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, “রমজানের শেষ দশকে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবাদতের জন্য লুঙ্গি শক্ত করে বেঁধে ফেলতেন। অর্থাৎ ইবাদতের জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। আর সারা রাত জাগ্রত থেকে ইবাদতে মশগুল থাকতেন এবং স্বীয় পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন।” (বুখারি ও মুসলিম শরিফ)
বলা বাহুল্য, রমজানের বিশেষ নামাজ ‘তারাবি’ও রাতের নামাজে সংযুক্ত আছে। আর তারাবি সম্পর্কে হজরত আবু হুরায়রা (রা.)—এর হাদিস এসেছে, “যে ব্যক্তি সাওয়াবের আশায় রমজান মাসে তারাবি আদায় করবে, আল্লাহ তায়ালা তার অতীতের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।” (বুখারি ও মুসলিম)
রাতের ইবাদতের মধ্যে আরেকটি হচ্ছে তাহাজ্জুদ। শেষ রাতের তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত সারা বছরই বেশি। রমজান মাসে তো এই বেশির তুলনা দেওয়াই কঠিন। তা ছাড়া যেহেতু সেহরি খেতে শেষ রাতে জাগ্রত হতে হয়, তাই এ মাসে তাহাজ্জুদ আদায় তুলনামূলক সহজ। সুতরাং, এই সুযোগ হাতছাড়া করাটা হবে বোকামি। তাহাজ্জুদের ফজিলত এত বেশি যে, আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় হাবিবকে এই নামাজের জন্য বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে, “আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ আদায় করুন। এটা আপনার জন্য অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায়, আপনার রব আপনাকে প্রশংসিত অবস্থানে অধিষ্ঠিত করবেন।” (আল কুরআন, সুরা ইসরা, আয়াত: ৭৯)
এ মাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নফল ইবাদত হতে পারে পবিত্র কুরআনের তিলাওয়াত। আমরা জানি, কুরআনের প্রতি হরফ তিলাওয়াতের বিনিময়ে দশগুণ করে সাওয়াব লেখা হয়। কিন্তু এই দশগুণ যদি রমজানের বিশেষ সত্তর গুণে পরিবর্তিত হয়, তবে সেটা সাত’শ গুণে পৌঁছে যায়। এ ছাড়াও আল্লাহ তায়ালা এ মাসকে “কুরআন নাজিলের মাস” বলে বিশেষায়িত করেছেন পবিত্র কুরআনেই। অতএব, এ মাসে যতটা সম্ভব কুরআন তিলাওয়াত মগ্ন হওয়া কর্তব্য।
রমজানের আরেকটি বিশেষ ইবাদত হচ্ছে ইতিকাফ। ইতিকাফ হচ্ছে যাবতীয় দুনিয়াবি কাজ থেকে বিমুখ হয়ে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য আদায়ের লক্ষ্যে মসজিদে অবস্থান করা। মহিলাদের ক্ষেত্রে বদ্ধ ঘরে আবদ্ধ হওয়া। সারা মাস, বিশ দিন, দশ দিন কিংবা তিনদিনের জন্যও ইতিকাফ করা যায়। তবে রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফের বিশেষ ফজিলত বর্ণিত হয়েছে হাদিসে। নবিজি নিজেই শেষ দশকে ইতিকাফ আদায় করতেন এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি রমজান মাসে দশদিন ইতিকাফ করল, সে যেন দুটি হজ এবং দুটি ওমরা আদায় করল।” (বায়হাকি, শুয়াবুল ইমান)।
একদম শুরুর হাদিস অনুসারেই স্বাভাবিকভাবে নফল ইবাদতের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে রমজানে সেটার গুরুত্ব বেড়ে যায় আরো বহুগুণ। ইবাদতের আবহ নিয়ে আগমন করা রমজান তার নানান অনুষঙ্গ দিয়ে আমাদের ইবাদতমুখী হবার আহ্বান জানায় প্রতিনিয়ত। ফরজের বাইরেও অতিরিক্ত হিসেবে নফলের মাধ্যমে যতটা সম্ভব পুণ্য আমাদের আমলনামায় সঞ্চিত হোক, এটাই প্রার্থনা। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাওফিক দান করুন।