রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন পর্যালোচনা করলে দান করার বিভিন্ন তরিকা, আদব বা শর্তাবলি পাওয়া যায়। দানের বিষয়ে একটি বিষয় সদাসর্বদা স্মরণে রাখা জরুরী, আল্লাহ নিজেই পবিত্র এবং পবিত্রতাকে পছন্দ করেন। সুতরাং দানের অর্থকড়ি বা দানকৃত বস্তু অবশ্যই হালাল হতে হবে। পাশাপাশি উত্তম বস্তু দান করার ব্যাপারেও তাগিদ প্রদান করা হয়েছে। কেননা, প্রিয় ও উত্তম বস্তু ব্যতীত দান কবুল হয় না। যেমন আল্লাহ তায়া’লা বলেন, ‘তোমরা কখনোই কল্যাণ লাভ করবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু থেকে দান করবে।’ (আলে ইমরান ৯২)।
সদকা করতে হলে একনিষ্ঠতা রক্ষা করা জরুরী। অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে দান করতে হবে; দুনিয়াবি কোন স্বার্থ চরিতার্থ করতে নয়। তাছাড়া গোপনে সদকা, খুশিমনে দান-সদকা এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রকৃত হক্বদারের নিকট পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারেও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ প্রদান করেন।
পাশাপাশি দানের ব্যাপারে কিছু কাজ বর্জন করতে বলেছেন। তন্মধ্যে অন্যতম হলো- দান করে খোঁটা না দেয়া। এতে করে সওয়াবের পরিবর্তে গুনাহের ভাগিদার হতে হয়। পাশাপাশি স্বার্থ হাসিলের জন্য দান করতে নিষেধ করেছেন। দান হতে হবে নিঃশর্তভাবে এবং দুনিয়াতে এর বিনিময় আশা করা যাবে না।
দান করার ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন বস্তু দান করতে পারি। তবে নিজের প্রয়োজনীয় অথবা প্রিয় বস্তু দানে আল্লাহ অত্যধিক খুশি হন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী দেখলে পাওয়া যায়, দান করার উত্তম ক্ষেত্র হলো- যে দানের মাধ্যমে সাধারণভাবে সব মানুষ উপকৃত হয়। যেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ বেশি উপকৃত হয়, সেক্ষেত্রে দান করাই সবচেয়ে বেশি সওয়াবের কাজ। আমরা সকলেই জানি, প্রকাশ্যে কোন আমল রিয়া বা লৌকিকতার অন্তর্ভুক্ত। দান-সদকার ক্ষেত্রে অনুরূপ বিধান নয়। লৌকিকতার বিবর্জিত দান-সদকা প্রকাশ্যে করা যাবে। সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রকাশ্যে দান করা যায়। আর্ত-মানবতার সেবায় একে অন্যকে এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করে তোলার জন্য প্রকাশ্যে দান করা যায়; নিজ সামর্থ্যের জানান দিতে নয়। রাসূল স. ও সাহাবীদেরকে বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায় যে, তারা দানের ক্ষেত্রে প্রকাশ্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন। একে অপরকে দানের প্রতি আগ্রহী করে তোলার মানসে, অনেকের সম্পদ আছে, কিন্তু দানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছেন না; তাদের সেই বোধ জাগ্রতকরণের লক্ষ্যে প্রকাশ্য দান করা যাবে।
বিশেষকরে, যেকোন দুর্যোগ বা মহামারিতে ব্যাপকহারে অর্থ ও পণ্য সহায়তার প্রয়োজন হয়েছে; তখন সর্বমহলে দানের প্রেরণা জোগানোর মানসে, সব ধরনের আত্মঅহংকার ও লৌকিকতামুক্ত হয়ে মহান রবের সন্তুষ্টির জন্য তারা প্রকাশ্য দানের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। যেমন আল্লাহ তায়া’লা বলেন: ‘ঐসব লোক, যারা নিজেদের সম্পদ দান করে রাতে ও দিনে, গোপনে ও প্রকাশ্যে, তাদের জন্য পূণ্যফল রয়েছে তাদের রবের নিকট। তাদের না আছে কোন আশংকা, না আছে কোন দুঃখ।’ (সূরা বাকারা-২৭৪)
উপরিউক্ত আয়াতের ঠিক দু’আয়াত পিছনে অগ্রসর হলে আমরা দেখতে পাই, প্রকাশ্যে দান করার চেয়েও গোপনে দান আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়। যেমন আল্লাহ তায়া’লা বলেন: ‘যদি তোমরা দান প্রকাশ্যে করো, তবে তা উত্তম। আর যদি তা গোপনে করো এবং অভাবীদের দাও, তবে তা তোমাদের জন্য শ্রেয়। এর মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের মন্দগুলো মোচন করে দেবেন। তোমরা যা করো, আল্লাহ তা অবগত আছেন।’ (সুরা বাকারা-২৭১)।
গোপনে দানকে অধিকতর উৎসাহ দিতে বিভিন্ন হাদিসেও পরিলক্ষিত হয়। যেমন- রাসুল স. বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা ভালোবাসেন। এর মধ্যে একজন হলো ঐ ব্যক্তি, যিনি এমনভাবে দান করেন যে, দাতা ও বাহক ছাড়া অন্য কেউ তার খোঁজ পায় না।’ (তিরমিজি- ২৫৬৮)।
গোপনে দানের ব্যাপারে রাসূল স. অন্যত্র বলেন: ‘কিয়ামতের দিন যখন আরশের ছায়া ছাড়া কোনো ছায়া থাকবে না, তখন আল্লাহ তা’য়ালা সাত শ্রেণির মানুষকে তাঁর আরশের নিচে আশ্রয় দেবেন। তাদের মধ্যে একজন হল ঐ ব্যক্তি, যে এমন গোপনে দান করত, ডান হাত দান করত অথচ বাম হাত টেরও পেত না। (বুখারি)
তাছাড়া বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে প্রকাশ্য দানে উপকারের চেয়ে বরং ক্ষতির পরিমাণ বহুগুণে বেশি। কারণ সাহায্যপ্রার্থীর করুণ মুখখানি সহজে ছড়িয়ে পড়ছে দেশ-বিদেশে। এতে করে তার নিজের মনোক্ষুণ্ণ হয় এবং ছাড়েন একবুক কষ্ট নিয়ে দীর্ঘশ্বাস! এমনকি দানগ্রহীতা ব্যাক্তির সমাজে অবস্থান নিচু হয়। তার পরিবার-পরিজন, সন্তানাদির চোখে যেমন তিনি লজ্জিত হন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদেরও লজ্জায় পড়তে হয়। প্রভূত এসব কারণে অনেকে চক্ষুলজ্জায় দান গ্রহণ করতে আসেন না।