হলিডে মার্কেটটি আগারগাঁও আইসিটি রোডে নির্বাচন ভবন এর সামনে থেকে শুরু করে সঙ্গীত কলেজ পর্যন্ত উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত। আইসিটি রোডের আইল্যান্ডের পশ্চিম পাশের রাস্তাটি পুরোটাজুড়ে, ফ্যাশন, লাইফস্টাইল, হোমডেকর, ফ্যাশনেবল প্রোডাক্ট, জুয়েলারী, হ্যান্ডিক্রাফটস, এগ্রো পণ্য, ফুড প্রোডাক্ট এবং খাবারের স্টলে সাজে প্রতি সপ্তাহে। হলিডে মার্কেটে ঢুকতেই মন জুড়িয়ে গেলো বসন্তের মৃদুমন্দ বাতাসে, সুপ্রশস্ত রাস্তায় আইল্যান্ডের দুই পাশে সারি সারি আমব্রেলার নীচে দোকান।
কাছেই কোন গাছে লুকিয়ে মন মাতানো বসন্তের গান গাইছে কোকিল, কুহু কুহু শব্দে মন কেমন চঞ্চল হয়ে ওঠে, সুন্দর রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজছে মাইকে, বাজছে নানান বাংলা গান। এই মার্কেটটিতে ১০০’র কাছাকাছি এসএমই উদ্যোক্তার জন্য বড় বড় ছাতা দিয়ে, লাইট দিয়ে, উদ্যোক্তার অভিনব স্টাইলে দোকান সাজিয়ে দিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এবং ঐক্য ফাউন্ডেশন যৌথভাবে।
একটু এগিয়েই দেখা গেলো ক্রিস্টাং। ক্রিস্টাং এর উদ্যোক্তা হোসনা ইমদাদ স্বর্ণা হ্যান্ডমেড জুয়েলারী, ইউনিক ফ্যাশন আইটেম, ঝিনুক, শামুক, হ্যান্ডমেড মেটাল চুড়ি, নেকলেস, আংটি, বালা, নোসপিন, নোজ রিং, এয়ার পিন, এয়ার রিংএমন শত সুতার রঙে স্টিল, কড়ি, ঝিনুক ও পুঁতিতে পণ্যের সমাহার সাজিয়ে বসেছেন। ব্লিস টেক্সটাইল এর তরুণ উদ্যোক্তা সৌরভ ঘোষ এনেছেন সিরাজগঞ্জের লুঙ্গী এবং গামছা।
আরেকটু এগিয়েই দেখা গেলো একটা আমব্রেলা ও টেবিল। ঝলমলে এক তরুণ উদ্যোক্তা হাসিমুখে দাঁড়ানো। টেবিলটাতে অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর পাথর সাজানো যেন, টেবিলটার ১০ পা দূরে থেকেই সৌরভে মন হয়ে ওঠে মাতোয়ারা। মারজিয়া মাহজাবিন, ‘ইলার্ডে’ তার, উদ্যোগ, তার স্টল। হ্যান্ডমেড সাবানের ভুবন সাজিয়ে বসেছে মারজিয়া। নিম ও তুলসী, টারমারিক এন্ড মুলতানি, এলোভেরা সোপ, চারকোল সোপ নানা রকম ফ্লেভারে নানা রকম উপাদানে তৈরি হ্যান্ডমেড সোপ। সবচাইতে বড় একটি আনকমন প্রোডাক্ট, এসএমই উদ্যোক্তা মারজিয়া এনেছেন তার ন্যাচেরাল হ্যান্ডমেড সোপ এর স্টলে- সেটি হচ্ছে সম্মানিত হাজীদের জন্য বিশেষ সাবান। হজ্ব করতে যাবেন যারা, তারা কিনতে পারেন বিশেষ এই সাবান।
দর্শকদের সাথে কথা বললে ডা: পলাশ বললেন, প্রতি সপ্তাহে শিশু সন্তানকে বেড়াতে নিয়ে আসেন এই মার্কেটে। খুশি খুশি মনে ছোট্ট শিশুর হাত ধরে ঘুরছেন বাবা। ডা: পলাশ ডিএনসিসি-ঐক্য হলিডে মার্কেট সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বললেন তিনি হলিডে মার্কেটকে নাম্বার দিতে চান ১০ এ ৮. এবার আসি আইল্যান্ডের অপজিটে। উদ্যোক্তা সানজিদা লোপা। নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশের জিআই পণ্য টাঙ্গাইলের বিখ্যাত চমচম, একদিনেই ৫০ হাজার টাকার মিষ্টির অর্ডার পেলেন।
আরেকটি জিআই পণ্য পাশের স্টলেই-সেটি হলো তিলের খাজা। তরুণ উদ্যোক্তা মুড়ি, চানাচুর, খই, মুড়কি, যবের ছাতু, ছোলার ছাতু, লাল আটা, লাল চাল, সব হোমমেড খাবার নিয়ে এসেছেন হলিডে মার্কেটে। ইউরিয়া ছাড়া বালিতে ভাজা হয় মুড়ি, খই এর অসাধারণ স্বাদ ক্রেতাদের মুখে, তিলের খাজা আনামাত্র প্রথমদিনেই শেষ। উদ্যোক্তা শিউলী ভীষণ খুশি। কুমড়া বড়ি সব বিক্রি করে প্রত্যয়ী চেহারা নিয়ে দাড়িয়ে আছেন নিজের স্টলে। ট্র্যাডিশনাল দোকান, কেমন সেল হচ্ছে জানতে চাইলে বললেন-আলহামদুলিল্লাহ।
এবার ভিন্ন এক পণ্য, অনলাইনে কেক এর ব্যবসা করেন ইসরাত ইয়াসমিন, বাটার ক্রিম এন্ড স্পাইস। শুক্রবার বিকেল ৫টা থেকে বোনকে নিয়ে বসে মাত্র ৩ ঘন্টায় ১২হাজার টাকার কেক বিক্রি করে ফেলেছেন। ছোট্ট ছোট্ট ছেলে মেয়েরা আনন্দ করে খাচ্ছে স্টলের চেয়ারগুলিতে বসে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য।
পিঠার স্টলে এত্তগুলো ঐতিহ্যবাহী পিঠা-সাইনা পিঠা,ভাপা পুলি পিঠা, ভাপা নারকেল পুলি পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, কামরাঙ্গা পিঠা, জামাই পিঠার দেখা মিললো আসমা হেনা সিমির দোকানে। ৮০০০ টাকা সেল করে ফেলেছেন শুক্রবার বিকেল থেকে রাত ৮টার মধ্যে।
আরো কয়েক পা হেঁটে যাই, ফারহানা বহ্নি- ফারহানাস কেক কর্ণার নিয়ে। ১২০ পিস কাপ কেক বিক্রি করে ফেলেছেন বিকেল থেকে সন্ধ্যা অব্দি, সুপার ফ্লেভারে ১২টি বড় কেক বিক্রি করেছেন রাত ৮টার মধ্যে। এই ফারহানায় আগের সপ্তাহে ২ দিনে হলিডে মার্কেটে বিক্রি করেছেন ৩৫ হাজার টাকার কেক, পেয়েছেন বেশ বড় বড় অর্ডার।
এছাড়া রোলার আইসক্রিম, দোসার স্টলে দেখা গেলো অফিস কলিগদের একটি দলকে, সব কলিগরা আনন্দ নিয়ে খাওয়া দাওয়া করছেন। হাঁসের মাংস, লুচি, নেহারী, রুটি। সব মিলিয়ে ‘ভাইবোন স্পেশাল হালিম এন্ড চিকেন’ ২০ হাজার টাকা সেল করেছেন শুক্রবার রাত ৮টার মধ্যে।
কুষ্টিয়া থেকে তৃতীয় লিঙ্গের উদ্যোক্তা মাহিন, সকল পণ্য বিক্রি করে ফেলেছেন প্রথম দিনেই। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন মেয়র আতিকুল ইসলাম কে ধন্যবাদ জানালেন সকল উদ্যোক্তার মতোই। মাহিন বললেন ঘরে চাল থাকতোনা,এই হলিডে মার্কেটে পণ্য বিক্রি করেই সাবলম্বী হয়েছেন তারা, নিয়মিত হলিডে মার্কেটে পণ্য বিক্রি করে গত ১টি বছরে অর্থনৈতিকভাবে বেশ সচ্ছল হয়েছেন তারা। ৪০জন তৃতীয় লিঙ্গের কর্মীদের নিয়ে কাজ করেন মাহিন। হাতে তৈরি আয়না, ঝাড়বাতি, ঐতিহ্যবাহী পালকি,পাখা, নানান ডিজাইনের ওয়াল হ্যাঙ্গিং,উইন্ড চাইম এছাড়াও এক্সেপশনাল হ্যান্ডমেড পাটজাত পণ্য তৈরি করছেন মাহিন। ২দিনে প্রায় ৩০ কার্টন পণ্য বিক্রি করে ফেলেছেন। অর্ডার মিলেছে ৫০হাজার টাকার পণ্য।
এসএমই খাতের হাজার হাজার পণ্য, ফুড ও কালিনারি স্টলগুলোতে হাজার পণ্যে মুখরিত হয়ে উঠছে ডিএনসিসি ঐক্য হলিডে মার্কেট। শুক্র ও শনিবার দুইটি ছুটির দিনে সকাল ১১টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত আগারগাঁও আইসিটি রোড ঝলমলে উঠছে, হাঁকে ডাকে সরব হয়ে উঠছে এসএমই পণ্যের মার্কেট।
ছুটির দিন গুলোতে মানুষের মন চায় ঘুরে বেড়াতে, চায় মুক্ত পরিবেশে বিনোদন, পরিবার পরিজন কিংবা প্রিয়জনকে ছোট কোন গিফট কিনে দিতে কিংবা খাওয়া-দাওয়া করতে। ডিএনসিসি ঐক্য হলিডে মার্কেট শুধু এমন ব্যাপারগুলোই নয়। ঈদ শপিং কিংবা যেকোন উৎসবের শপিং ও এখন থেকে সম্পূর্ণ করে ফেলা সম্ভব বলে মনে করছেন আয়োজকরা।
আয়োজকরা বলেন, ‘ধীরে ধীরে এক বড় মার্কেটে পরিণত হচ্ছে এসএমই হলিডে মার্কেট-ডিনসিসি-ঐক্য হলিডে মার্কেট। নাগরদোলা, খাওয়া-দাওয়া, দেশি-বিদেশি খাওয়া, ডিনার, চটপটি, ফুচকা, মিউজিক লোকাল ট্যালেন্ট শো, এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য এওয়ার্ড অনুষ্ঠান, আছে হাজার হাজার এসএমই পণ্য কেনার শোকেস, এমনটি বাংলাদেশের আর কোথাও দেখা যায়নি। বিদেশে অনেক নাইট মার্কেট, হলিডে মার্কেট বসে কিন্তু বাংলাদেশে এটিই প্রথম। উত্তরের নগরপিতা এটিকে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতই একটি হলিডে মার্কেট এবং নাইট মার্কেট হিসেবে চিন্তা করছেন।
অনেক ক্রেতা আসছেন, দেখছেন কিনছেন, কিন্তু ‘এসএমই’ শব্দটির সঙ্গে অনেক ক্রেতারই কোন পূর্ব পরিচিতি ছিলোনা। ডিএনসিসি ঐক্য হলিডে মার্কেট- এসএমই এবং এসএমই উদ্যোক্তাদের চিনিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশে মার্কেট হিসেবে প্রথম এবং নিয়মিত। জাতীয় এসএমই মেলার পর এটাই এসএমই উদ্যোক্তাদের সবচাইতে বড় উন্মুক্ত শো কেস দাবী করেন আয়োজকরা।
ঐক্য ফাউন্ডেশন-উন্নয়নের জন্য সিএমএসএমই এই শ্লোগানে কাজ করছে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এবং ঐক্য ফাউন্ডেশনের যৌথভাবে এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য এমন আয়োজনে সন্তুষ্ট উদ্যোক্তারা। এই মার্কেটে এ প্রধান উন্নয়ন সহযোগী, এসএমই ফাউন্ডেশন, উন্নয়ন সহযোগী এটুআই, একশপ, আইসিটি ডিভিশন এবং নাসিব।২৩, ২৪ ফেব্রুয়ারি হলিডে মার্কেট নিয়ে এ রিপোর্টটি লেখা পর্যন্ত ৭০ জন উদ্যোক্তা ২দিনে ১৪ লক্ষ ৮৫ হাজার ৯৯০ টাকার এসএমই পণ্য বিক্রি করেছেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)