এই খবরটি পডকাস্টে শুনুনঃ
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শহীদ শরিফ ওসমান হাদিকে নির্বাচনী প্রচারে যাওয়ার সময় হত্যার পর খুনিদের নিরাপদে সীমান্ত পার করে দেওয়ার একটি সুপরিকল্পিত নেটওয়ার্কের তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
ঘটনার রাতেই ফয়সাল ও আলমগীর ঢাকা ছাড়েন এবং একাধিক যানবাহন পরিবর্তন করে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্তে পৌঁছান। সেখান থেকে তারা অবৈধভাবে ভারতে পালিয়ে যান।
তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন এবং গ্রেপ্তারদের দেওয়া জবানবন্দি পর্যালোচনা করে রোববার সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য দেন ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম।
গোয়েন্দারা বলছেন, বিকেল ৪টা ৫৪ মিনিটে পশ্চিম আগারগাঁও থেকে সিএনজিতে করে আমিনবাজারে যায় ফয়সাল। সেখান থেকে উবারে ধামরাইয়ের কালামপুর, এরপর ভাড়া করা প্রাইভেটকারে নবীনগর হয়ে গাজীপুরের চন্দ্রা-মাওনা পেরিয়ে পৌঁছায় ময়মনসিংহে। সেখান থেকে হালুয়াঘাটের ধারাবাজার পেট্রোল পাম্পে যায় তারা। পাম্পের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, রাত ১১টা ৩১ মিনিটে সেখানে পৌঁছায় শ্যুটারদের বহনকারী প্রাইভেটকার। মানবপাচারকারী ফিলিপ স্নাল মোটরসাইকেলে এসে তাদের রিসিভ করে সীমান্তের দিকে নিয়ে যান।
পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ফিলিপের দুই সহযোগীর বক্তব্য অনুযায়ী, ভুটিয়াপাড়া সীমান্ত দিয়ে শ্যুটাররা ভারতে পালিয়ে যায়।
তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন ফয়সাল সকাল ১১টা ৫ মিনিটে আগারগাঁওয়ের বাসা থেকে মোটরসাইকেলে বের হয়ে সরাসরি যান হাদির সেগুনবাগিচার প্রচারণায়। সকাল পৌনে ১২টার দিকে সেখানে পৌঁছান।
প্রচারণা শেষে দুপুর ১২টা ২২ মিনিটে হাদি মতিঝিলের উদ্দেশে রওনা হলে শ্যুটাররা পেছন থেকে তার অটোরিকশা অনুসরণ করতে থাকেন। দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে হাদিকে বহন করা অটোরিকশা মতিঝিলের জামিয়া দারুল উলুম মসজিদের সামনে পৌঁছায়। আলমগীর মোটরসাইকেল পার্ক করলে দুজন নেমে আবারও প্রচারণায় যুক্ত হন।
নামাজ শেষে দুপুর ২টা ১৬ মিনিটে হাদি সেখান থেকে রওনা হলে শ্যুটাররাও পিছু নেয়। দৈনিক বাংলা মোড়ে ডান দিকে ঘুরে পল্টনের বক্স কালভার্ট সড়কে ঢুকে পড়ে তারা। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ফাঁকা জায়গা খুঁজে বেড়ানোর পর দুপুর ২টা ২৪ মিনিটে খুব কাছ থেকে হাদিকে লক্ষ্য করে দুটি গুলি ছোড়ে ফয়সাল।

সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, হত্যাকাণ্ডের পরপরই ঢাকা মহানগর পুলিশ, ডিবি, সিটিটিসি, র্যাব, সিআইডি এবং বিজিবি ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য কাজ আরম্ভ করে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্য, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ, ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স এবং তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় ঘটনার দিনই শ্যুটার ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ ওরফে রাহুল এবং তার সহায়তাকারী মোটরসাইকেল চালক মো. আলমগীর শেখকে শনাক্ত করা হয়। তাৎক্ষণিক তাদের গ্রেপ্তারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক টিম সাভার, হেমায়েতপুর, আগারগাঁও, নরসিংদীতে অভিযান পরিচালনা করে। ধারাবাহিক অভিযানের অংশ হিসেবে ডিএমপির একটি টিম ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের সীমান্তবর্তী এলাকায় ও অভিযান পরিচালনা করে।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট মামলাটি নিবিড় তদন্তের জন্য ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। তদন্তকালীন এ যাবৎ এই ঘটনা সংঘটনে পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ, ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র-গুলি লুকানোর সাথে জড়িত, ঘটনার মূল দুই হোতাকে পলায়নে সহায়তাকারীসহ মোট ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার হলেন, হুমায়ুন কবির, হাসি বেগম, সাহেদা পারভীন সামিয়া, ওয়াহিদ আহমেদ শিপু মারিয়া আক্তার লিমা, মো. কবির, নুরুজ্জামান নোমানী ওরফে উজ্জ্বল, সিবিয়ন দিও, সঞ্জয় চিসিম, মো. আমিনুল ইসলাম রাজু ও মো. আব্দুল হান্নান।
এই ঘটনায় জব্দ করা উল্লেখযোগ্য আলামত হলো: হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত দুইটি বিদেশি পিস্তল, ৫২ রাউন্ড গুলি, ম্যাগাজিন ও ছোরা, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও ভুয়া নম্বর প্লেট, ঘটনার সময় ওসমান হাদিকে বহনকারী অটোরিক্সা, ঘটনাস্থল থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত গুলির খোসা, বুলেট, ভিডিওচিত্র, সিসিটিভি ফুটেজ ও অন্যান্য আলামত, প্রায় ৫৩টি ব্যাংক একাউন্টের ২১৮ (দুই শত আঠারো) কোটি টাকার স্বাক্ষরিত চেক।
সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আরও জানান,চাঞ্চল্যকর এই ঘটনায় মামলাটি পুলিশ অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছে। গ্রেপ্তারদের কাছে পাওয়া তথ্য, সাক্ষীদের জবানবন্দি, উদ্ধার আলামত সমূহ পর্যালোচনা এবং সার্বিক বিবেচনায় মামলাটির তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আগামী ৭ জানুয়ারীর মধ্যে এ মামলার চার্জশিট প্রদান করা হবে। এই জঘন্য ঘটনায় ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে পুলিশের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।








