চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

অদক্ষতায় বাজেটের বেশিরভাগ অর্থই খরচ করতে পারে না স্বাস্থ্য খাত

শেষ দুই বছরে কোভিডের সময় বরাদ্দ বাজেটের প্রায় ৬০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করতে পারেনি স্বাস্থ্য বিভাগ। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা স্বাস্থ্য খাতে সক্ষমতার অভাব ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কথা বলেছেন। তাদের মতে, দক্ষতার অভাবেই স্বাস্থ্য খাতের বাজেট অব্যয়িত থাকছে।

বরাদ্দ অর্থ কেন খরচ করতে পারে না স্বাস্থ্য বিভাগ- এমন প্রশ্নে বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা স্বাস্থ্য খাতের বাজেট তৈরি এবং তা ব্যয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত; এ বিষয়ে তাদের যথেষ্ট পরিমাণ অভিজ্ঞতা বা দক্ষতা নেই। বরাদ্দ পাওয়া বাজেটকে যথাযথভাবে ব্যয় কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে পরিকল্পনাকারীদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে।

যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ করা টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দিষ্ট কোডের বিপরীতে বরাদ্দ দেয়া হয়। সেই কোডের বাইরে অন্য কোনো কোডে ওই টাকা খরচের কোনো সুযোগ নেই। এই নিয়মের ফলে যে বিপুল টাকা খরচ করা সম্ভব হয় না- তা নির্ধারিত কোডেই অব্যয়িত অবস্থায় থেকে যায়।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের (২০২২-২০২৩) জন্য ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছে মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য ২৯ হাজার ২৮১ কোটি ৮১ লাখ টাকা রাখা হচ্ছে। চলতি অর্থবছর (২০২১-২০২২) এ খাতে রাখা হয়েছিল ২৫ হাজার ৯১৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।

কোভিড ১৯ মোকাবেলায় গৃহীত কার্যক্রমগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনায় নিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ খাতে চলতি অর্থবছরের জন্য ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল।  যা আগের অর্থবছরে (২০২০-২০২১) ছিল ২৯ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা ছিল।

ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী

স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বরাদ্দের টাকা কেন ব্যয় করতে পারছে না স্বাস্থ্য বিভাগ- এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে চ্যানেল আই অনলাইন সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছে, এ খাতের উন্নয়নে যে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় তার সিংহভাগই মূলত নতুন হাসপাতাল নির্মাণ, ভারী যন্ত্রপাতি কেনাকাটার পেছনে ব্যয় হয়। বাকি অর্থ ব্যয় হয় প্রয়োজনীয় ওষুধ সামগ্রী, গজ, ব্যান্ডেজ, তুলাসহ অন্যান্য সামগ্রী ও পথ্য কেনাকাটার পেছনে।

প্রতি তিন মাস অন্তর হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী এসব সামগ্রীর জন্য অর্থ ছাড় করা হলেও ভারী যন্ত্রপাতি কেনা হয়নি। সারাদেশে ভারী যন্ত্রপাতি কেনার কাজের দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় ঔষধাগারও প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করেনি। এসব কারণে সিংহভাগ অর্থ অব্যয়িত থেকে গেছে। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে সংস্কারে হাত দিতে হবে নাকি, স্বাস্থ্য খাত সংস্কার করার পর সেই অনুযায়ী বরাদ্দ দিতে হবে? সেটিও একটি বড় প্রশ্ন।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) এর মহাসচিব ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘যারা স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বরাদ্দ এবং ব্যয় করেন, তাদের যথেষ্ট পরিমাণ অভিজ্ঞতা কিংবা দক্ষতা নেই। শুধু মাত্র বাজেট বাড়ালেই হবে না, তা ব্যবস্থাপনায় ও যথাযথভাবে ব্যয়ের পরিকল্পনায় সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণেরও প্রয়োজন রয়েছে।’

‘‘তাছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্নীতির বিষয়গুলোও সামনে চলে আসে। এসব মিলিয়ে আমাদের পরামর্শ হলো শুধুমাত্র স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বৃদ্ধি নয়, সেই বাজেটগুলো সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে কিভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দৌড়গড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া যায় সেই পরিকল্পনা করার জন্য তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য দেশে-বিদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাপক পরিমাণে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন।’’

ড. আতিউর রহমান

এ খাতের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে অনভিজ্ঞদের বসানো হয়েছে জানিয়ে বিএমএ মহাসচিব বলেন, ‘ইদানিং যেসব গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে; সেসব পদে যাদেরকে বসানো হয়েছে, তাদের সেই কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা কম। সুতরাং বসানোর আগে চিন্তা করা উচিত এই ব্যক্তিটি এই পদে বসানোর জন্য যথাযথ যোগ্য কিনা। তার পর ওই ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি তার পদে তার কাজের জবাবদিহিতা থাকতে হবে।’

‘স্বাস্থ্য খাত যা বরাদ্দ পায় তা চৌকসভাবে খরচ করতে পারে না’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও উন্নয়ন সমন্বয়ের সভাপতি ড. আতিউর রহমান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, স্বাস্থ্য খাত যা বরাদ্দ পায় তা চৌকসভাবে খরচ করতে পারে না। কর্মসূচি বাস্তবায়নকারী ব্যক্তিদের সক্ষমতা কম।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগ উন্নয়ন বাজেটের অর্ধেকও খরচ করতে পারে না। সরকার ব্যয় সংকোচনের নীতি নিয়েছে। সে ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় সংকোচন না করে ব্যয়ের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। দামি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে মনোযোগ কমিয়ে দরকার জনবল ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যে ব্যয় বাড়ানো উচিত।

অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ

‘স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার করা পরেই বরাদ্দ’
স্বাস্থ্য খাত সংস্কার করার পর সেই অনুযায়ী বরাদ্দ দিতে হবে- এমন পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ।

চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য বাজেটের উন্নয়ন অংশের ব্যয় নিয়ে সমস্যা হচ্ছে, কেনাকাটার বিষয়ে আটকে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের দক্ষতা কম। তাদের প্রশিক্ষণের ঘাটতি আছে, এসব বিষয়ে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে আছি। এ–সংক্রন্ত নিয়মকানুনেও গলদ আছে। সমস্যা আছে অডিট বা নিরীক্ষণে। সঠিক কাজটা কি করা উচিত, সেটা করছে না।’

‘কেনাকাটায় বিকেন্দ্রীকরণে মান সম্মত ব্যয় নিশ্চিত হবে’
গণতান্ত্রিক বাজেট আন্দোলনের সহ-সভাপতি আমান রহমান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: কেনাকাটায় বিকেন্দ্রীয়করণ ও মান নিয়ন্ত্রণ করলে স্বাস্থ্য খাতে মান সম্মত ব্যয় নিশ্চিত হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে কেনাকাটায় আমাদের প্রচুর দুর্নীতির রিপোর্ট আমরা দেখেছি। সুতরাং কেন্দ্রীয়ভাবে কেনাকাটা করলেই যে মান নিয়ন্ত্রণ হবে কিন্তু দুর্নীতির চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স না থাকলে সেটা সম্ভব না।

আমান রহমান

‘‘মানুষের যে রোগ নির্ণয় কেন্দ্র, ওষুধ এবং অন্যান্য সার্ভিসগুলো দরকার সেই সার্ভিসগুলো পাচ্ছে না। কোভিডের সময় আমরা দেখেছি যে অক্সিজেন সিলিন্ডার জেলা বা উপজেলা এমনকি বিভাগীয় পর্যায়েও অপ্রতুল।

এখানে যে জেলা বা উপজেলা হাসপাতালগুলো আছে, প্রত্যেককে তাদের জায়গা থেকে কেনাকাটা বিকেন্দ্রীয়করণ করা উচিত। তাতে সঠিকভবে খরচ করা সম্ভব হতে পারে। তবে এখানেও সঠিক চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স করতে হবে; যাতে মানসম্মত কেনাকাটা করা যায়।  একই সাথে আমরা বলি যে ইউনিয়ন পরিষদগুলোতেও কমিউনিটি ক্লিনিক সার্ভিস দিতে পারি। কিছু কিছু জায়গায় যদি সার্ভিসগুলো যদি বিকেন্দ্রীয়কারণ করতে পারি তাহলে মান সম্মত ব্যয় নিশ্চিত করতে পারবে স্বাস্থ্য বিভাগ।’’

ডা. আহমদ পারভেজ জাবীন

জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. আহমদ পারভেজ জাবীন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘সরকারি আর্থিক খরচের কিছু কিছু বাধ্যবাধ্যকতা আছে।  সেগুলো যদি কিছুটা শিথিল করা হয়; তাহলে স্বাস্থ্য খাতে অপারেশন প্ল্যান্টগুলোতে ব্যয়টা বৃদ্ধি পাবে।’

‘‘সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত বিভিন্ন হাসপাতালের পরিচালক সীমিত আকারে খরচ করতে পারেন, অতিরিক্ত পরিচালক- মহাপরিচালক সীমিত আকারে খরচ করতে পারেন। এসব বাধ্যবাধ্যকতা তুলে দিলে বরাদ্দ বাজেট দ্রুত বাস্তবায়িত হবে।’’

যা বলছে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ
এ নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘কোভিডের সময় গত দুই বছরে বাজেট বরাদ্দের প্রায় ৬০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করতে পারেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কোভিড মহামারির সময় স্বাস্থ্য খাতে যেসব খরচ হয়েছে তা; বেশির ভাগই বিভিন্ন দাতা গোষ্ঠীর ও সরকারের থেকে বরাদ্দ বা অন্যান্য বরাদ্দ থেকে এসেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ করা টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিদিষ্ট কোডের জন্যই বরাদ্দ করা হয়। সেই কোডের বাইরে অন্য কোডে এই টাকা খরচ করার কোনো সুযোগ নেই। ফলে কোডের টাকাগুলো থেকে গেছে অব্যয়িত অবস্থায়।’

‘‘স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বরাদ্দের বিষয়ে নানাভাবে গণমাধ্যমে এসেছে। এর মধ্যে অন্যতম স্বাস্থ্যে দুর্নীতি হয় কিন্তু বরাদ্দ বাজেট খরচ করতে পারে না। করোনার দু’বছরে বাংলাদেশে সব মন্ত্রণালয় বন্ধ থাকলেও তারা প্রায় শতভাগ অর্থ ব্যয় করতে সক্ষম হয়েছে। অথচ ওই দুই বছরে যতো কাজ হয়েছে সব স্বাস্থ্যখাতে, কিন্তু স্বাস্থ্যখাতে প্রায় ৬০ ভাগের বেশি টাকা অব্যয়িত থেকে গেছে।

বিভিন্ন কোডে দেখা গেছে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ খরচ হয়েছে। এখানে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে কোভিড চলাকালীন সময়ে যেসব মন্ত্রণালয়ের কোনো কাজ ছিল না; তাদের টাকা খরচ হলো কীভাবে? তাদের দুর্নীতি ছাড়া এ টাকা খরচ করার কোনো উপায় আছে কিনা?’’

তিনি আরও বলেন, ‘দ্বিতীয় কথা হচ্ছে স্বাস্থ্যের যে বাজেট হয়, সেটা সম্পূর্ণ জনসম্পৃক্ত। এর সঙ্গে সরাসরি জনগণের সম্পৃকতা থাকে এবং সুবিধাভোগী জনগণ। স্বাস্থ্য বাজেটের ছোটখাট বিষয়ও গোপন রাখা যায় না। সহজে প্রকাশ হয় এবং তা গণমাধ্যমে চলে আসে। তাই বিষয়গুলো জানাজানি হয় কিন্তু অন্যান্য মন্ত্রণালয় যে শত শত হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে থাকে সেগুলোর সাথে জনসম্পৃক্তা না থাকায় কোথা থেকে খরচ হলো এগুলো কিন্তু দৃশ্যমান হয় না।’

‘‘এছাড়াও বাজেট কম খরচ হয় নানান জটিলতায় চিকিৎসকরা বিদেশ সফরে যেতে পারে না, কেনাকাটার ক্ষেত্রেও দেখা যায় যে নির্দিষ্ট সময়ে ক্রয় তালিকায় অন্তর্ভুক্তি করতে না পারায় ওই সব হাসপাতাল, প্রত্যন্ত অঞ্চল, জেলা এবং উপজেলা পর্যায় থেকে যারা সময় মতো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারে না। তারা কিন্তু ওই অর্থ বছরে কেনাকাটার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে আরও কিছু টাকা অব্যয়িত থেকে যায়। যেভাবে ঢালাও করে অভিযোগ দেওয়া হয় সেটা বলা উচিত নয়।’’