গীতগোবিন্দম্-এর শ্রষ্ঠা কবি জয়দেবকে নিয়ে লেখা বাংলা সাহিত্যে প্রথম জীবনী উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে ‘ভক্ত কবি জয়দেব’। কলকাতা বইমেলার আগেই এই উপন্যাস প্রকাশ করেছে কলকাতার বিভা পাবলিকেশন। আর বইটি লিখেছেন রাধামাধব মণ্ডল।
এই উপন্যাসকে ঘিরে কি তাহলে এবার বাংলা আর উড়িষ্যার বিবাদ মিটবে! না কি বাড়বে! ইতিহাসইবা কী বলছে! ইতিহাস আর দীর্ঘ গবেষণাধর্মী এই উপন্যাসে লেখক তুলে ধরেছেন অজয়তীরের কেন্দুলী, মন্দিরা গ্রাম আর কাঁকসার সেনাপাহাড়ির রাজা লক্ষ্ণণ সেনের গড়কেল্লা অঞ্চলের ইতিবৃত্ত।
এই কথাটুকু বললেই এই উপন্যাসটির প্রতি সুবিচার করা হবে না বলে মনে করেন স্বয়ং লেখক। নিরন্তর শ্রমদানে এবং গভীর গবেষণায় এই উপন্যাসের ভিত্তি রচিত হয়েছে বলে জানান তিনি। রাঢ়ের মানুষ হওয়ার জন্যই বোধহয় রাধামাধব এরকম একটি উপন্যাস রচনার গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে পেরেছেন বলে মনে করেন সমকালের অন্যান্য লেখকরা।
লেখকের লেখালেখির সূত্রপাতও কেন্দুলিকে ঘিরেই, সেই কেন্দুলি যা আজও বিখ্যাত কবি জয়দেবের নামমাহাত্মে। শেষপৌঁষের মকর মেলার প্রাচীন এই নদীতীরের ইতিহাসটিও কবি জয়দেবকে ঘিরেই আবর্তিত।
এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কবি জয়দেব হলেও উপন্যাসটি আসলে রাঢ়বঙ্গের একটি সময়ের সমাজ-জীবনের দলিলও। তাই এই উপন্যাসে সেই সময়ের বঙ্গদেশের রাজা লক্ষণ সেন যেমন হাজির, তেমনই হাজির অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষজনরাও। উপন্যাসের শুরুতেই দেখা মেলে ঢেকারো কামারদের। কাহিনিতে মিশে গিয়েছে ইতিহাস, পুরাণ, লোককথা। আবার ইতিহাস-আশ্রিত এবং ঘটনানির্ভর হওয়া সত্ত্বেও মানব জীবনের নানা জটিলতাকেও এই কবি জীবনের কাহিনিটির পরতে পরতে বুনে দিতে সক্ষম হয়েছেন লেখক।
ঐতিহাসিক পটভূমিতে নির্মিত যে কোনো উত্তম উপন্যাস প্রশ্রয় দেয় কল্পনাকেও। এই উপন্যাসেও রাধামাধবের কল্পনা প্রয়োজন মতো উড়াল নিয়েছে। হয়তো এক কবির জীবনালেখ্য বলেই উপন্যাসটির কিছু কিছু অংশ প্রায় কবিতার মতো। গভীর এক দর্শনবোধও উপন্যাসটিকে পল্লবিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জল, আলো, বাতাস যুগিয়েছে। রাজা লক্ষ্ণণ সেন, কবিবন্ধু পরাশর, ভোজদেব আর পদ্মাবতীর জীবনও এসে মিশেছে কবি জয়দেবের জীবনকে ঘিরে। বর্গিদের রাজত্বের পাশাপাশি বাংলাদেশ, কাশী আর জগন্নাথ দেবও এসেছেন গীতগোবিন্দম এস স্রোতে।
গ্রামটি একটি ধর্মীয় তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে এই স্থানে বাউল মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই গ্রামে জয়দেব দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রাধামাধবের মূর্তির পুজো করা হয়ে থাকে এবং যে আসনে বসে তিনি সিদ্ধিলাভ করেছিলেন বলে মনে করা হয়, তা সংরক্ষণ করা রয়েছে। এই কেন্দুলী গ্রামের যুগলকিশোর মুখোপাধ্যায় ছিলেন বর্ধমান রাজদরবারের সভাকবি। মনে করা হয়, তার অনুরোধে বর্ধমানের মহারাণী ব্রজকিশোরী ১৬৮৩ খ্রিষ্টাব্দে এই কেন্দুলীতে জয়দেবের জন্মভিটেয় রাধাবিনোদ মন্দির স্থাপন করেন। যা আজও রয়েছে। তবে কবি জয়দেবের ‘রাধামাধবে’র যে মন্দির করে দিয়ে ছিলেন রাজা লক্ষ্ণণ সেন। তা চলে গেছে কালের গর্ভে। জয়দেবের সঙ্গে তাঁর আরাধ্যা ‘রাধামাধব’কে তিনি সঙ্গে করে নিয়ে যান বৃন্দাবনে। ১৮৬০-র দশকে নির্বাক বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের রাধারমণ ব্রজবাসী এই গ্রামে, বৃন্দাবন থেকে এসে তাদের কুলগুরু কবি জয়দেবের জন্মভিটেই নির্বাক আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন। তা এখনও রয়েছে বর্তমান কেন্দুলীতে ‘রাধাবিনোদ’ মন্দিরের পাশে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এই রাধাবিনোদের নবরত্ন মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
কবির পিতা ভোজদেব গোস্বামী আর মাতা বামাদেবীও এসেছে উপন্যাসের চরিত্রে।বাংলা,উড়িষ্যা ও দাক্ষিণাত্যর সংস্কৃৃতিতে কবি জয়দেবের প্রভাব আজও অনস্বীকার্য৷ কবি জয়দেব ছিলেন রাজা লক্ষ্মণ সেনের (১১৭৮-১২০৬) রাজসভার পঞ্চরত্নের অন্যতম একজন। অপর চারজন হলেন গোবর্ধন আচার্য, শরণ, ধোয়ী আর উমাপতিধর। সময়, কাল আর এক মহাজীবনের গল্প ভক্তকবির এই জীবনকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে।
আর কয়েকদিন। তারপরই অজয়তীরে মকরের কেন্দুলী মেলা। কীর্তন আর বাউলের সুর মাতবে ভুবন। দেশ বিদেশের বহু মানুষ আসেন এই বাঙালি কবির টানেই। এবিষয়ে লেখক রাধামাধব মণ্ডলকে জিজ্ঞেসা করা হলে তিনি বলেন, ‘খুব অভাব ছিল বাড়িতে! বাবা ইঁটভাঁটায় শ্রমিকের কাজ করতেন। সে সময় আমাদের কাছের শান্তিনিকেতন মেলায় গিয়ে থাকার সুযোগ ছিল না! ধনীব্যক্তিদের মেলা। সেখানে নামীদামী মানুষজনদের ভিড়! আর পয়সা না থাকলেও জয়দেবের স্মৃতিধন্য কেন্দুলীর মেলাতে বিনিপয়সায় গিয়ে থেকেছি। খেয়েছি। সেখানে আজও অন্নছত্র দেওয়া হয়। আশ্রমে আশ্রমে বিনিপয়সায় মানুষ গিয়ে থাকতে পারে। আমি এসব দেখে আশ্চর্য হয়েছি। একজন বাঙালি কবির প্রেমের টানে গোটা বিশ্বের মানুষ আশ্চর্য রকম ভাবে আসেন কেন্দুলীতে। আর মানুষের খাবারের অভাব নেই, এই গান মেলায়। সেই শুরু জয়দেব চর্চার। খুঁজতে শুরু করা কবিজীবন! লক্ষ্ণণ রাজত্বের ইতিহাস। কি ভাবে গড়ে উঠলো এই মস্তো গানমেলা, কবির স্মৃতিতে!’ এবছরের কলকাতার বিভা পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত হয়েছে উপন্যাসটি। ভক্ত কবি জয়দেব, সত্যিই এক মহাজীবনের গল্প।