দেশের ইউরিয়া সারের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ১৯৭০ সালে নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলায় বার্ষিক ৩ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিকটন উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরী লিঃ এবং ১৯৮৫ সালে বার্ষিক ৯৫ হাজার মেট্রিকটন উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা স্থাপিত হয়।
কারখানা দুটি অত্যন্ত পুরাতন হওয়ায় উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস এবং ডাউন টাইম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় গত ২৪ আগষ্ট, ২০১৪ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উক্ত পুরাতন কারখানা দুটির স্থানে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন, শক্তি সাশ্রয়ী, পরিবেশ বান্ধব ও আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর একটি সার কারখানা নির্মাণের নির্দেশনা প্রদান করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় ২৪ অক্টোবর ২০১৮ তারিখ বার্ষিক ৯ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিকটন উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা কার্যক্রম শুরু হয়।
এই সার কারখানাটি এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম ইউরিয়া সার কারখানা।দেশের ৩৫ শতাংশ ইউরিয়া সার উৎপাদন হবে এই সার কারখানার মাধ্যমে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১২ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে এই সার কারখানাটি উদ্বোধন করেন।
সক্ষমতা
দেশে ইউরিয়া সারের চাহিদা বছরে ২৬ লাখ টন। স্থানীয় কারখানা থেকে সার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১০ লাখ টন। বাকিটা আমদানি করতে হয়।ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা চালু হলে দেশে সার উৎপাদন বেড়ে দাঁড়াবে ২০ লক্ষ টন। এই সার কারখানাটিতে দৈনিক ২ হাজার ৮০০ টন এবং বছরে প্রায় ১০ লক্ষ টন সার উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। এই সার কারখানাটি জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব। পলাশ ও ঘোড়াশালের পুরোনো দুটি কারখানায় যে পরিমাণ গ্যাস লাগত, একই পরিমাণ গ্যাস দিয়ে নতুন কারখানায় আগের দুটি কারখানার চেয়ে ৩ গুণ বেশি ইউরিয়া উৎপাদন করতে পারবে।
নতুন সার কারখানা দুটিতে বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে দৈনিক ২৮ মেগাওয়াট। যেখানে ৩২ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ২টি অত্যাধুনিক স্টিম গ্যাস জেনারেটর রয়েছে।জেনারেটর দুটি সবসময় ৫০ শতাংশ লোডে চলবে। তাই এই কারখানাটির ২টি স্টিম গ্যাস জেনারেটর ১০০ শতাংশ লোডে চালিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
এই সার কারখানাটি বাংলাদেশের প্রথম সার কারখানা যেটি দূষিত গ্যাসগুলো আকাশে ছেড়ে না দিয়ে তা ধরে রেখে প্রজেক্ট প্রসেসের মাধ্যমে অতিরিক্ত আরো ১০ ভাগ ইউরিয়া সার উৎপাদন করতে পারবে।
এছাড়া উদ্বৃত্ত সার মজুদ করার জন্য কারখানাটিতে রয়েছে ১ লক্ষ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন অত্যাধুনিক বাল্ক স্টোরেজ। এমনকি বেঁচে যাওয়া এমোনিয়া স্টোরেজের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে অত্যাধুনিক স্টোরেজ ট্যাঙ্ক। লিকেজ এবং দুর্ঘটনা প্রতিরোধের জন্য কারখানাটিতে রয়েছে সয়ংক্রিয় ওয়াটার পন্ড এবং ওয়াটার কার্ডেন।
বর্তমান সরকার এবং বিএনপির আমলের পার্থক্য
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিলো বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন নিয়ে। তারই লক্ষ্যে তিনি কৃষি এবং কৃষকের উন্নয়নে নানাবিধ পরিকল্পনা হাতে নেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে শাহজালাল সার কারখানা নামে আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন, শক্তি সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব সার কারখানা নির্মাণ করেন। যার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৫ লাখ ৮০ হাজার ৮০০ মেট্রিকটন এবং কারখানাটিতে ২০১৬ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে সার উৎপাদন শুরু হয়।
সেই ধারাবাহিকতায় ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া সার কারখানাটি সম্পূর্ণ অত্যাধুনিক এবং উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন করে গড়ে তোলার উদ্যোগ হাতে নেওয়া হয় ।যে কারখানাটি ১২ অক্টোবর ২০২৩ তারিখ থেকে পরীক্ষামূলক ভাবে সার উৎপাদন শুরু করে।
অথচ বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের আমলে সারের সংকটে সাধারণ কৃষক রাস্তায় নেমেছিলো, আন্দোলন করেছিলো। আর সেই আন্দোলনে পুলিশি বর্বরতা চালানো হয় যেখানে কৃষকদের ওপর নির্মমভাবে গুলিবর্ষণ করে মোট ১৭ জন কৃষককে হত্যা করা হয়।
সুযোগ সুবিধাসমূহ
সাশ্রয় হবে ২২ হাজার কোটি টাকা – ঘোড়াশাল-পলাশ সার কারখানাটি পুরোদমে চালু হলে দেশে ইউরিয়া সারের উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে ২০ লক্ষ মেট্রিক টন হবে।এতে করে আমদানি নির্ভরতা পাঁচ ভাগের এক ভাগে নেমে আসবে। এর ফলে বিদেশ থেকে সার আমদানিতে যে টাকা ব্যয় হয়, সেখান থেকে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার সাশ্রয় হবে।
ইউরিয়া সার আমদানিতে দিতে হবে না ভর্তুকি- বর্তমানে সরকারকে ইউরিয়া সার আমদানিতে প্রতি বছর ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়।কারখানাটি চালু হলে এই ভর্তুকি আর দিতে হবে না।
সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন, শক্তি সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব ইউরিয়া উৎপাদনে সক্ষম এই সার কারখানা দেশে ইউরিয়া সারের স্বল্পতা ও ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
কারখানাটি দেশের কৃষি উৎপাদন, কৃষি অর্থনীতি, ব্যবসা বাণিজ্যে এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে । এছাড়া কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা বৃদ্ধি পাবে এবং দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
প্রকল্প ব্যয় এবং সহযোগী সংস্থা
১১০ একর জমিতে ১৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় কারখানাটি।মোট ব্যয়ের মধ্যে সরকার ৪ হাজার ৫৮০ দশমিক ২১ কোটি টাকা দিয়েছে এবং ১০ হাজার ৯২০ কোটি টাকা জাইকা, এইচএসবিসি ও ব্যাংক অব টোকিও মিতসুবিশি ইউএফজে লিমিটেড থেকে ব্যবসায়িক ঋণ প্রকল্পের মাধ্যমে পেয়েছে।