আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে ‘ফুটবলার জনি’ নামটা এখনও অনেক অনেক সমাদৃত। ফুটবলের সোনালী যুগের অন্যতম এক সিপাহসালার ইমতিয়াজ সুলতান জনি। সাবেক এই তারকা ফুটবলার ‘লেফটব্যাক’ পজিশনে খেলতেন। ‘কুলম্যান’ হিসেবে বিশেষ খ্যাতি ছিল তার। মাঠে কখনই মেজাজ হারাতেন না। দেশের দুই শীর্ষ ক্লাব আবাহনী লি. (সাবেক আবাহনী ক্রীড়া চক্র) এবং মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব দু-ক্লাবেই খেলেছেন, তাও দীর্ঘদিন। তবে শুধু বড় দুই ক্লাবে খেলা বলে নয়, ফুটবলে প্রতিপক্ষকে সামলাতে যে মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ের দরকার হয় সে লড়াইয়ে তিনি নিজেকে নিতে পেরেছিলেন অনন্য এক উচ্চতায়। রাফ এন্ড টাফ ট্যাকল বা স্লাইডিংয়ের চেয়ে কৌশলে আটকানো বা রুখে দেওয়াতে তিনি ছিলেন পারদর্শী। প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকার বা কোনো বল প্লেয়ারকে আটকাতে কখনই তিনি ডি বক্সের আশেপাশে নিষ্ঠুর বা নির্মম হতেন না। শুধু সেন্সকে কাজে লাগিয়েই গোলকিপারকে নিঃশ্বাস নেওয়ার নিশ্চয়তা দিতেন। এ কারণেই ‘কুলম্যান’ হিসেবে তিনি যে খ্যাতি পেয়েছিলেন সেই খ্যাতির গল্প ফুটবলাঙ্গন থেকে এখনও নিঃশেষ হয়নি। এখানেই শেষ নয়, ফুটবলে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দানেও তিনি ছিলেন পরিপক্ব। আর তাই জাতীয় দলের আর্মব্যান্ড তার হাতে শোভিত হয়েছে তার আমলের খেলোয়াড়দের চেয়ে অনেক অনেক বেশিবার।
’৯৪ সালে ফুটবল থেকে বিদায় নেন ইমতিয়াজ সুলতান। সে বিদায়ে কোনো আনুষ্ঠানিকতা বা পুষ্পবৃষ্টিতে ভেজার বিষয় ছিল না। রেগুলার প্লেয়ার থাকতেই বুটজোড়া গুছিয়ে ফেলেন আর মাঠে নামেননি। তবে যতদিন ছিলেন উচ্চশিরেই ছিলেন। আবাহনী ও মোহামেডান দু-ক্লাবের হয়েই তার অর্জন ঈর্ষণীয়। আবার জাতীয় দলের নেতৃত্বেও আলোকিত হয়েছেন। বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব, এশিয়ান কাপ কোয়ালিফাইং খেলেছেন। ১৯৮৫ সালে তিনি ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সাফ গেমসে জাতীয় ফুটবল দলের নেতৃত্ব দেন। ১৯৮৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দলের নেতৃত্ব দেন। ১৯৮৭ সালে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত তৃতীয় সাফ গেমস এবং ১৯৮৮ সালে আবুধাবিতে নবম এশিয়ান কাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ছিলেন।
ইমতিয়াজ সুলতান জনির প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে আগমন ছিল ১৯৭৯ সালে রহমতগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে হয়ে। লিংকম্যান হিসেবে শুরুটা হলেও পরে পজিশন মজবুত হয় লেফট ব্যাকে। নিচ থেকে উপর সচল থাকতেন। স্ট্রাইকারদের অনেক গোলের উৎসে থাকতেন তিনি। রহমতগঞ্জ হয়ে ১৯৮২ সালে যোগ দেন সেই সময়ের তারুণ্যদীপ্তময় জনপ্রিয় ক্লাব আবাহনী ক্রীড়াচক্রে। আবাহনীর হয়ে টানা চার বছর ছিল তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময়। প্রথম বছরেই ফেডারেশন কাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন ও লিগে রানার্সআপ হয় তার দল আবাহনী। এরপর ফুটবল লিগে হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন (১৯৮৩, ১৯৮৪, ১৯৮৫) হয় আবাহনী। ১৯৮৫ সালে তিনি ছিলেন আবাহনীর অধিনায়ক। তার যোগ্য নেতৃত্বে আবাহনী ক্রীড়া চক্র লিগ ও ফেডারেশন কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়। কিন্তু পরের বছরই তার ঠিকানা বদল হয়, চলে আসেন সাদা কালো শিবিরে। ১৯৮৬ সাল থেকে তার ঠিকানা হয়ে ওঠে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। মোহামেডানও হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন (১৯৮৬, ১৯৮৭, ১৯৮৮) হয়।
১৯৮২ সালে জনির আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক হয়। এরপর থেকে জাতীয় দলের অপরিহার্য সদস্য হিসেবে বিবেচিত হন তিনি। ১৯৮২ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ সবুজ দলের জার্সি পরে তার আলোকময় যাত্রা হয়েছিল। এরপর ভারতে অনুষ্ঠিত নবম এশিয়ান গেমস, ১৯৮৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দল, মালয়েশিয়ায় ২৭তম মারদেকা ফুটবল, ১৯৮৪ সালে নেপালে প্রথম সাফ গেমস, ইন্দোনেশিয়ায় ৮ম এশিয়ান কাপ ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ড, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় দ্বিতীয় সাফ গেমস- সবখানেই তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। ’৯৪ সালে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল থেকে বিদায় নিলেও মাঠ ছাড়েননি। ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন অনেকবার।
গত ১১ মে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার গ্রহণ করেন সাবেক এই তারকা ফুটবলার ইমতিয়াজ সুলতান জনি। আসলে এ পুরস্কার তার প্রাপ্য ছিল আরও অনেক আগেই। ২০১৪ সালের জন্য তাকে এই পুরস্কারে মনোনীত করা হয়। জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পাওয়ায় সাবেক ফুটবলার ইমতিয়াজ সুলতান জনি খুবই খুশি। খুশির কারণ একই পরিবারে আপন দুই ভাই’র জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার প্রাপ্তি। তার আপন ভাই প্রয়াত মোহাম্মদ এহতেশাম সুলতানও জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পান ২০০৬ সালে। একই পরিবারের দুই ভাই এমনতরো স্বীকৃতি পাওয়ায় খুশি না হওয়ার কোনো কারণ নেই।
ফুটবলকে ছেড়ে যাননি ইমতিয়াজ সুলতান জনি। ব্যবসা আর ঘর সংসার সামাল দেওয়ার পরেও ফুটবলের জন্য ছুটে চলেছেন। সেই ছুটে চলা থেকে থামেননি। ফুটবলের সাথে থাকলেও ফুটবলের সেই পুরনো জৌলুশ, ফুটবলের সৌন্দর্য, সেই মাঠভরা দর্শক ভীষণরকম মিস করেন জনি। তিনি বলেন, ‘ফুটবল ক্রমশই জনপ্রিয়তা থেকে সরে যাচ্ছ। আর এই সরে যাওয়ার পেছনের অন্যতম কারণ হলো- আন্তর্জাতিক লেভেলে ভালো ফলাফল করতে না পারা। শুধু জাতীয় দল নয়, ক্লাব টিমগুলোকেও আন্তর্জাতিক লেভেলে ভালো করতে হবে। যতদিন না আমরা ভালো করতে পারব ততদিন ফুটবল মূল আলোচনায় আসবে না। সেই পরিকল্পনা নিয়েই এগুতে হবে নইলে শুধুই সময়ের অপচয় হবে। সবাইকেই এদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।’
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)