মানব শরীরের তাপমাত্রা ও পানির সাম্যতা রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে কোন কারণে যদি ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় তখন পুরো ব্যবস্থাপনায় ভেঙ্গে পড়ে। এ জন্য থামোরেগুলেশন এবং অসমোরেগুলেশন মানব শরীর সহ অন্যান্য প্রাণীর জন্য অত্যাবশ্যক কার্যক্রম। ছোট বেলা থেকে আমরা শুনে আসছি অতিরিক্ত যেকোন জিনিসই খারাপ। প্রয়োজনের চেয়ে বেশী খারাব ও শরীরের জন্য বিষ। ভারসাম্যতা বা হোমিও ষ্ট্যটিস সামাজিক জীবন ,ব্যক্তিগত জীবন ও পরিবেশ সকল ক্ষেত্রেই অতিব জরুরী। মানব শরীরে পানি ও তাপের-ভারসাম্যতা পরিবেশের তাপমাত্রার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
পরিবেশের অনন্য উপাদান ও জনস্বাস্থ্যে সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে। শরীর বৃত্তীয় সকল কার্যক্রম সঠিকভাবে চলতে শরীরের তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকা জরুরী। এই তাপমাত্রায় শরীরের সকল এনজাইস হরমোন সঠিক ভাবে কাজ করে। যদি এর চেয়ে বাড়তে থাকে তবে নেগেটিভ কিডব্যাকের মাধ্যমে শরীর তা ঠিক রাখার চেষ্টা করে । কিন্তু অতিরিক্ত বেড়ে গেলে শরীরের হোমেওষ্টেসিস প্রক্রিয়া আর কাজ করেনা। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার হিসাবে অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট জায়গার দৈনিক যে গড় তাপমাত্রা বিরাজ করে তা থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেলে এবং তা পরপর ৫দিন চলমান থাকলে তাকে হিটওয়েভ বলা হয়। আমাদের দেশে এই হিটওয়েভ শুরু হয় ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে (আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভাষ্য মতে )। বর্তমানে কিছু কিছু স্থানে তা প্রায় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাহলে বুঝতে আর বেশী কষ্ট হওয়ার কথা নয় আমরা কি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। বিগত ২৮ বছরের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে প্রচণ্ড দাবদাহে জ্বলছে সারাদেশ। এই পরিস্থিতি কি মানব সৃষ্ট না কি প্রকৃতিক প্রতিশোধ। আমরা যে ভাবেই বলি না কেন মূল কারিগর হল মানুষ। কারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধির সকল প্যারামিটার আমরা মাত্রারিক্ত ভাবে বেড়েই চলেছি। খুব গভীর ভাবে না ভাবলেও হবে। সাধারণ ভাবেই যদি চিন্তা করেন দেশে জীবশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার প্রতিক্ষণ বাড়ছে না কমছে। প্রতিদিন ব্যক্তিগত ও প্রতিষ্ঠানিক গাড়ীর সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। বাড়ছে জীবশ্ম জ্বালানী পুরানোর পরিমাণ। সারা বিশ্বের জীবশ্ম জ্বালানীর পোড়ানোর কাজ প্রতিদিন বেড়েই চলছে। এই সাথে আমাদের দেশের তো কথাই নেই। ১৯৫০ সাল থেকে আজ পযর্ন্ত তা কয়েক গুন বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিদিন রেফ্রিজেরেটর এবং এসি ব্যবহারের পরিমাণ এক্সপোনেনমিয়ালভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে বনায়ন ধ্বংসের পরিমাণ, অকল্পনীয় ভাবে এবং অপরিকল্পিত ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে কনক্রিটের বাড়ী ঘর। এবার আসছি এতগুলো বৃদ্ধির কবলে পড়ে যে মূল্যবান জিনিসটি হারিয়ে ফেলেছি তা হলো গ্রিন হাউজ গ্যাস গুলোকে গ্রহণ করে বাতাসকে বিশুদ্ধ ও পরিশুদ্ধ করে সেই সবুজ গাছপালাকে।
জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক কর্ম পরিকল্পনার তথ্য অনুসারে কোন আইডিয়াল শহর হলো যে শহরে ২৫ শতাংশ বনায়ন বা গাছপালা আছে। ২০২০ সালের এক জরিপে দেখা যায় ঢাকা শহরে বনায়নের পরিমান ৮ শতাংশ। বর্তমানে তা আারও কমে যাচ্ছে বিপরীত দিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ইট পাথরের ইমারত আর ইট বানানোর ভাটা। ঢাকা শহরের প্রতিটি সিগন্যালে প্রতিদিন পড়ছে বিশাল বিশাল জ্যাম যা অকল্পনীয়ভাবে গ্রিন হাউজ গ্যাসের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। যা এমন এক ট্র্যাপ তৈরি করছে যার মধ্যে সূর্যের আলো প্রবেশ করছে কিছু কিছু ওয়েভ লেন্থ বা তরঙ্গ দৈর্ঘ পরিবতন করে আর সেই ট্র্যাপ থেকে বের হতে পারছে না। যার ফলে প্রতিনিয়তই তাপমাত্র বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
একই ভাবে কিছু গ্যাস ওজোন (O3) এর সাথে বিক্রিয়া করে তা ছিদ্র করে ফেলছে এবং এই ছিদ্র দিয়ে আরও ভয়ঙ্কর অতিবেগুনী রশ্নি প্রবেশ করে ক্যান্সারের মত ভয়াবহ রোগ তৈরি করছে। একইভাবে তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যত গুলো গ্রিন হাউজ গ্যাস আছে তাদের মধ্যে কার্বন ডাই অক্সাইড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই গ্যাসটি সবুজ গাছ দ্বারা শোষিত হয়ে সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার কাঁচামাল হিসাবে কাজ করে। এই গ্যাসটি ডিফরেষ্টেশন বা বনায়ন ধ্বংসের কারনে একদিকে যেমন শোষিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না ,অন্য দিকে তেমন ইটের ভাটা ও জীবশ্ম জালানীর যথেচ্ছা ব্যবহারের ফলে দিন দিন কার্বন ডাই অক্সাইড মারাত্নক ভাবে বেড়েই চলছে।
এই নাজুক পরিস্থিতি অবসান কিভাবে সম্ভব ?
প্রথমত: দেশের সকল বড় বড়, শহরের বনায়ন এর শতকরা ভাগ নির্ণয় করতে হবে। সকল বিভাগীয় ও জেলা শহরে দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যাক্তিবর্গ সমাজের সকল শ্রেনী পেশার মানুষের সাথে আলাপ আলোচনা করে সামাজিক বনায়ন নিশ্চিত করতে হবে। অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বনায়নের প্রয়োজনীয়তা বুঝাতে হবে। এটা ধরিত্রীর কুলিং সিষ্টেম হিসাবে কাজ করে। মানবদেহের ফুসফুস যেমন পরিস্কার বাতাস গ্রহণ করে রক্ত পরিস্কার করে দেহের সকল কার্যক্রম ঠিক রাখে তেমন ভাবে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বনায়ন কোন এলাকার সকল দূষিত বাতাস বা কার্বন ডাই অক্সাইড যুক্ত বাতাস গ্রহণ করে অক্সিজেন যুক্ত বাতাস সরবরাহ করে। যে হারে জীবশ্ম জালানী পুরে কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনো অক্সাইড ও অন্যান্য ক্ষতিকারক পদার্থ তৈরি হচ্ছে অপর দিকে সবুজ বনায়ন ধ্বংস হচ্ছে এরই মারাত্নক প্রভাব হিসাবেই এই অস্বাভাবিক তাপমাত্রা।
দ্বিতীয়ত: শহরাঞ্চলে যে সকল পার্ক বা বিনোদনের জায়গা আছে যেসব স্থানে সবুজ গাছপালা সংরক্ষণ ও বর্ধন নিশ্চিত করতে হবে। যেসব রাস্তার পাশে কোন গাছ নেই অথবা গাছের উপর ধুলাবালির মোটা আস্তরন পড়ে মৃত প্রায় সেই সকল রাস্তার পাশে গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং সংস্কার করে পরিচ্ছন্ন গাছ সংরক্ষণ করা জরুরী। বিশেষজ্ঞেদের দ্বারা গঠিত টিম দিয়ে গাছের শ্রেণী বিভাগ করে স্থান ভেদে তা রোপন ও পরিচর্চা নিশ্চিত করতে হবে ।
তৃতীয়ত: বনায়ন ধ্বংসের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত আইনের প্রয়োগ হতে হবে সিদ্ধ হস্তে। কারণে অকারণে কোন ভাবেই গাছ কাটা যাবে না । একান্ত প্রয়োজনে একটা গাছ কাটলে কমপক্ষে ২টি গাছ লাগাতে হবে। কারণ সবুজ বনায়নের পরিমাণ কোনভাবেই ২৫ শতাংশের এর কম হওয়া যাবে না।
চতুর্থত: যে সকল জলাধারের পাড়ে ব্যক্তি মালিকানায় গাছ পালা আছে সেগুলো সংরক্ষণে জনসচেতনতা ও সম্পূক্ততা বৃদ্ধি করতে হবে। এবারের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের স্লোগান হলো “আমার স্বাস্থ্য ,আমার অধিকার ” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে যেমন দুটি বিষয় আমাদের সামনে প্রতিয়মান হয় তাহলে ১. স্বাস্থ্যে আমার নিজের দায়িত্ব ২. স্বাস্থ্য আমার অধিকার। স্বাস্থ্যকে বিশ্বের কমপক্ষে ১৪০টি দেশ মানবাধিকার হিসাবেই বিবেচনা করে তাদের নিজ নিজ সংবিধানে অর্ন্তভূক্ত করেছে। এই অধিকার সংরক্ষনের পথে অনেকগুলি বাধা আছে। মানবাধিকার যেমন ভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। যেমন ভাবে যুদ্ধ বিগ্রহ হানাহানি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে মানবাধিকার খর্ব হচ্ছে একইভাবে পরিবেশের উপর নির্মম নিষ্ঠুর আচারণ করে প্রকৃতিকে করে তুলছি বিরূপ। তাই শান্তি স্থাপন করে প্রকৃতির স্বহজাত অবস্থান ফিরিয়ে এনে আমার অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি নিজে মনোনিবেশ করা। নিজে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করে নিয়মিত ব্যায়াম ও শরীর চর্চার মাধ্যমে নিজের দায়িত্ব পালন করা। আর এভাবেই গড়ে উঠুক সুস্বাস্থ্যের শান্তিময় পৃথিবী।
(এই বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)