‘কচিকাঁচা’ মাসিক ম্যাগাজিন দিয়ে গল্প পড়া শুরু। কিশোর বাংলা। তারপর রোমেনা আফাজ এর ‘দস্যু বনহুর ‘ থেকে বইয়ের নেশা লাগতে থাকে। আনোয়ার হোসেন এর কুয়াশা। মাসুদ রানা সিরিজ পড়লেও দুই -চারটা। এরপর ঝুঁকে পরলাম নিহাররঞ্জন গুপ্তের বইয়ের প্রতি। ধীরে ধীরে বইপড়ার অগ্রগতিতে রুচির পরিবর্তন হতে লাগলো। অগণিত বই পড়তে লাগলাম। ময়মনসিংহ মুসলিম ইনস্টিটিউটের বিশ্ব সাহিত্যের বই পড়লাম বেশ কিছু। আমার পড়া বইয়ের ভিতর মুষ্টিমেয় কয়েকটা বইয়ের নাম আমার কাছে বিশেষভাবে উল্লিখিত। যেমন, শংকরের ‘মুক্তির স্বাদ’, ম্যাক্সিমগোর্কির ‘মা’, বর্তমান সময়ে আনিসুল হকের ‘মা ‘।
যাইহোক, এইভাবে আমার পড়া বইয়ের শ্রেষ্ঠত্ব বাছাই করা আলোচ্য বিষয় না। আজকের আলোচ্য বিষয় বাংলা সাহিত্যের বর্তমান সময়ের প্রখ্যাত লেখক অমর কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ আর তিন-চার দশকব্যাপী বাংলা চলচ্চিত্রে জনপ্রিয় অভিনেত্রী কবরী সারোয়ার।
গতকাল ১৯ জুলাই হুমায়ূন আহমেদ এর মৃত্যু দিবস আবার কবরীর জন্মদিন। এই জনপ্রিয় দুইজন মানুষই আজ শুধুই স্মৃতির পটে ভেসে আছেন। প্রিয় লেখক একবার ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবে আসছেন শুনে কাছ থেকে দেখার জন্য ছোট ভাইকে রাজি করালাম একসাথে যেতে। কিন্তু সিঁড়ি থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পেয়ে প্রেসক্লাবে আর যেতে পারলাম। এই ফাঁকে ছোট ভাইটিও সাথে যাওয়া থেকে বেঁচে গেল।
হুমায়ূন আহমেদ এর বই কিনতে ময়মনসিংহ সি,কে ঘোষ রোড সংকলন লাইব্রেরিতে এখনো আমার কাছে পাঁচ টাকা পায়। ১৯৮৯ এর দিকে হুমায়ূন আহমেদ এর অন্য বইগুলো কিনে টাকা কমে গেছে। তখন ‘তোমাকে’ বইটা দর কষাকষি করে সম্ভবত বইটার বিক্রয় মূল্য ৩৫টাকা। শেষ পর্যন্ত বিক্রেতা, পাঁচটাকা পরে দিয়েন বলাতে ‘তোমাকে’ কেনা হলো। বেশির ভাগ সময়েই হুমায়ূন আহমেদ এর একই বই দুইটা কিনতাম, এইজন্যে যে, কাউকে না কাউকে দিতে। তখন গিফট পেতে লোকজন বইই পছন্দ করতো। সেই ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদ এর বই হলে তো কথাই নেই। ময়মনসিংহের গাঙ্গিনার পাড় কবির লাইব্রেরি, পারুল লাইব্রেরি থেকে অনেক বই কিনেছি। ঐসব বইয়ের মধ্যে বেশির ভাগ বই হুমায়ূন আহমেদ এর। বই কিনে টাকা শেষ হয়ে গেলে হেঁটে বাসায় আসতাম।
এই ধরণের বাইরে যাওয়া-আসায় বড়ভাই দেখে ফেলে কি না এমন একটা ভয় কাজ করলেও তেমন কিছু বলতেন না। যে কড়াকড়ি অন্য বোনদের বেলায় ষোলোআনা। আমার মাও হুমায়ূন আহমেদ এর বইয়ের ভক্ত ছিলেন। তাই প্রায়ই আম্মা আর আমি প্রিয় এই লেখকের বইগুলো একসাথে মিলেমিশে পড়তাম। আম্মা বলতেন,মনে হয় বইয়ের ঘটনাগুলো আমাদের চারপাশেরই ঘটনা। আমার মা সঠিক মন্তব্যটিই করেছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ এর লেখাগুলো সত্যি বলতে মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রতিচ্ছবি। তিনি লিখেছেন শিক্ষিত মধ্যবিত্তের জন্য। ঐ সময় কফি তো দূরের কথা ঘরে ঘরে চায়েরই এতো প্রচলন ছিল না।
হুমায়ূন আহমেদ এর বই এর মতো আমাদের বাসায় ছোটদের চা দিলেও তা বরাদ্দ থাকতো আধা কাপ করে। এ সবই হুমায়ূন সমগ্রর মধ্যবিত্ত। আমার পড়া হুমায়ূন আহমেদ এর প্রথম বই ‘আমার আছে জল’। চরিত্র মূল্যায়ন করতে ‘আমার আছে জল’ বইটা পরপর দুইবার পড়লাম। কিন্তু সেইদিনের বিচার আর আজকের বিচারের পার্থক্য যথেষ্ট। সেই সময় বইটা পরে দিলু’র জন্য নিজই যেন জলে ডুবে যাই, এমন কিছু। ‘নন্দিত নরকে ‘ পড়ে কাহিনির মূল বিষয়ের চাইতে বারবার মনে হয়েছে আহা মন্টুর কেন ফাঁসি হলো, কেন লেখক মন্টুকে ফাঁসি দিল! ‘নির্বাসন’ পড়ে খুব কষ্ট হলো উপন্যাসের নায়িকা জরি’র জন্য। আজ চিত্রার বিয়ে। এই যে একটা ফুপু বা বোনের চরিত্র ফরিদা, আহ্ কতই না সহজ -সরল একটা মেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিল। এসব আমাদের চারপাশেরই জীবনের প্রতিচ্ছবি। আহারে জীবন। এমন আরও কতো বই পড়তে পড়তে কতো কষ্টই না পেয়েছি।
‘ শঙ্খ নীল কারাগার ‘ সহজ ভাষায় সাদা মাটা লেখা। অথচ অসাধারণ এক পরিবারের নিখুঁত বর্ণনা। খোকা,রুনু, ঝুনু, তাদের বাবা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় চরিত্র রাবেয়া চরিত্রটি। খোকাকে লেখা চিঠির প্রতিটি লাইনে রাবেয়া চরিত্রটি আরও প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। এই চরিত্রটি বাংলার অসাধারণ এক নারীর শাশ্বত রূপ।
এবার নাটকের কথায় আসা যাক। হুমায়ূন আহমেদ এর বিটিভিতে ৮০/ ৯০ এর দশকে প্রচারিত নাটকগুলো ছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এইসব দিনরাত্রি, অয়োময়ো, নক্ষত্রের রাত, কোথাও কেউ নেই। নাটকের প্রাণ হচ্ছে সংলাপ। আসাদুজ্জামান নুর, সুর্বণা মুস্তফা, দিলারা জামান, লাকী ইনাম, লুৎফুর নাহার লতা, শিল্পী সরকার অপু, ইনামুলহক বিপাশা হায়াত, শমী কায়সার এমন আরও যারা অসাধারণ অভিনয় শিল্পী তাদের মধ্যে ডলি জহুর, শীলা আহমেদ মেহের আফরোজ শাওন। বাকীদের নাম উল্লেখ না করলেও প্রত্যেকেই তাদের শৈল্পিক সত্ত্বায় সংলাপের মাধ্যমে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছেন। ‘কোথাও কেউ নেই ‘ নাটকটি দেশ জুড়ে কী আলোড়নই না সৃষ্টি হয়ে ছিলো। এমন নজির বাংলা সাহিত্যে বিরল।
চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে অসাধারণ সৃষ্টি শ্রবণ মেঘের দিন, আগুনের পরশমনি’র মতো প্রায় সবগুলো। ১৯৯৪ সালে ময়মনসিংহের দুটি সিনেমা হলে অজন্তায় চলছে সালমান সাহ -মৌসুমি অভিনীত ‘অন্তরে অন্তরে’ আর ছায়াবানীতে ‘শঙ্খনীল কারাগার’। আমার মেজোবোনসহ ( যে বোন বলতো তার দৃষ্টিতে বেঈমান সেরা ছবি) অন্যান্য কাজিনরা মিলে মতবিরোধ। শেষ পর্যন্ত আমরা ছায়াবাণী হলে শঙ্খনীল কারাগার দেখলাম। ডলি জহুর রাবেয়া চরিত্রে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেলেন। টেলিভিশনে দেখে ডলি জহুরের প্রতি ভালোলাগা আরও বেড়ে গেল, কারণ পুরস্কার গ্রহণের সময় তিনি এতোটাই সাদামাটা শাড়ি পরেছেন!
হুমায়ূন আহমেদ এর সর্বশেষ অসাধারণ সৃষ্টি ‘ঘেটুপুত্র কমলা। ‘ আহা! কতই না হৃদয় বিদারক দৃশ্য, ঘেটুপুত্র কমলাকে ছাদ থেকে ফেলে মেরে ফেলার দৃশ্য! ময়মনসিংহের ভাটি অঞ্চলে এক সময় যাত্রা /পালা গানের প্রচলন থাকত বর্ষাকালে।
মিনা পাল থেকে কবরী চৌধুরী থেকে কবরী সারোয়ার (সারা বেগম) চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জের অধিবাসী, অভিনেত্রী থেকে সংসদ সদস্য। শেষ পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবী ছেড়ে একেবারেই চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
সুবাস দত্ত পরিচালিত ‘সুতরাং’ কবরীর প্রথম ছবি। সত্যি সত্যিই বলতে হয় কী অসাধারণ প্রতিভা! ১৪/১৫ বছর বয়সের এক কিশোরী। যেমন অভিনয় তেমনি মিষ্টি -মায়াবী চেহারা। দক্ষতার সাথে নিখুঁত অভিনয় প্রতিটা ছবিই দর্শকের মনে দাগ কেটেছে। আজিম,ফারুক, উজ্জ্বল, আলমগীর, জাফর ইকবাল, বুলবুল আহমেদসহ বাংলা চলচ্চিত্রের প্রায় সব নায়কের বিপরীতে কবরী অভিনয় করেছেন। এরমধ্যে নায়ক রাজ রাজ্জাকের সাথে মিষ্টি মেয়ে কবরী বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ জুটি। রাজ্জাকের সাথে যেসব ছবিতে কবরী অভিনয় করেছেন এর কয়েকটি, ময়নামতি, দর্পচূর্ণ, রংবাজ, গুন্ডা অধিকার কত যে মিনতি,আগন্তুক, বেঈমান স্মৃতি টুকু থাক, পিতাপুত্র, চোখের জলে। কবরীর অন্যান্য যেসব ছবিতে অভিনয় করেছেন এর কয়েকটি, সাত ভাই চম্পা, সুজনসখী, সারেংবউ, আরাধনা, আপনপর অসাধারণ অভিনয় বধূবিদায়। লাভ ইন সিমলা। মিনিময় ছবিতে বোবা মেয়ের চরিত্রে দারুণ অভিনয়। প্রতিভাময়ী এই শিল্পী দীর্ঘ চার দশক ধরে সুনাম ও দক্ষতার সাথে অভিনয় করে দেশের হাজার হাজার মানুষের মনে আসন করে নিয়েছেন। সেই সময়গুলোতে শহরের লাইব্রেরিতে যেমন ছিল পাঠকের সরগরম তেমনি ছিল সিনেমা হলে দর্শকের যাতায়াত।
আমরা ময়মনসিংহের অলকা,ছায়াবাণী,পূরবীতে অগণিত সিনেমা দেখেছি। অজন্তা,সেনানিবাস হল দুটি পরে হয়েছে। পুরানো ছবি চলত অলকা হলে। তখন মানুষের মুখে মুখে শোনা যেত অমুক হল হাউসফুল। হলের ভিতর শেণি বিভাজন ছিল লেডিস,ফাস্ট-ক্লাস, ডিসি, গ্র্যানসার্কেল। চলত ম্যাটিনি সো, ফাস্ট সো, সেকেন্ড শো। তখন প্রিয় জুটি জুটি ছিল রাজ্জাক -কবরী । নীল আকাশের নীচে দর্শক নন্দিত রাজ্জাক -কবরীর আরও একটি চমৎকার ছবি। ‘ক খ গ ঘ ঙ ‘ ছবিটি চুয়াডাঙ্গায় শুটিং হয়। তাই সেখানে রয়েছে একটি কবরী রোড।
প্রখ্যাত লেখক ড. হুমায়ূন আহমেদ ও প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী সারা বেগম কবরী দুজন মানুষেরই অকাল মৃত্যুতে দেশ ও জাতির অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে। তাদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।
‘দিতে পার একশ ফানুস এনে, আজন্ম সলজ্জ সাধ আকাশে কিছু ফানুস উড়াই! অভিজ্ঞতা অর্জন করে কবরী চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেও কাজ করতে চেয়েছিলেন’।