শাস্ত্রে বলে, ঋষিরা মন্ত্র বানিয়ে লিখতেন না, তারা সেটি দেখতে পেতেন। দেবীদুর্গার পূজায় পাঠ করা হয় যে সূক্ত, তার মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি ছিলেন একজন নারী। এতে দেখা যাচ্ছে যে, নারীরাও মন্ত্রদর্শনের অধিকারী ছিলেন।
ঋকবেদের অম্ভৃণির সূক্তই বেদের ‘দেবীসূক্ত’ নামে খ্যাত, চণ্ডিপাঠে এই সূক্ত পড়তে হয়। যদিও বেদে দেবী দুর্গার কোনো বর্ণনা নেই। তবু অনেকে ঋকবেদের দেবীসূক্তকে দুর্গার সূক্ত বলেই মনে করেন। তবে মৎস্যপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবীপুরাণ, কালিকাপুরাণ ও দেবী ভাগবতের মতো প্রাচীন পুরানে আমরা দুর্গার বিবরণ পাই। পুরান মতে, দুর্গা দুর্গতিনাশিনী, আদিশক্তি মহামায়া তথা শিবের স্ত্রী পার্বতীর চণ্ডি বা উগ্ররূপ এবং শাক্তদের পূজিত।
বৈদিক সংস্কৃত ভাষায় লেখা প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋকবেদ। এটি বেদের চারখণ্ডের প্রথম। গবেষকরা আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ থেকে ১১০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়কে ঋগ্বেদ রচনার সময়কাল হিসেবে ধরেন। সনাতন ধর্মের আদি উৎস বেদে দেবতাদের গুণগান ও তাদের নিয়ে স্তোত্র বা শ্লোক, সূক্ত তথা মন্ত্র রচনার পাশাপাশি দেবী শক্তি, মহিমা বা শক্তি-উপাসনার প্রাচীন নজির হিসেবে যে সূক্তের উল্লেখ পাওয়া যায়, সেটি দেবীসূক্ত। সে হিসেবে এটি দেবীশক্তির মহিমার প্রাচীনতম নিদর্শনও বটে। তবে আরও গুরুত্বের বিষয় যে, এই ঋক বা মন্ত্রের রচনাকারীও একজন নারী ঋষি। এবার তার কথা বলি।
আনুমানিক সাড়ে তিন হাজার বছর আগের প্রাচীন ভারত। সেখানে জন্মেছিলেন আত্মজ্ঞানপিপাসু এক নারী। নাম তার বাক্। বাক অর্থ বাণী। মহর্ষি অম্ভৃণের কন্যা তিনি, তাই আরেক নাম অম্ভৃণি। অম্ভৃণি বা বাক দেবীসূক্ত রচনা করেছেন বলে একে অম্ভৃণিসূক্ত বা বাকসূক্ত-ও বলা হয়। সূক্ত শব্দের অর্থ হলো, যা সু বা শোভন ভাবে বলা হয়।
‘অহম্ রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যমাদিত্যৈরুত বিশ্বদেবৈঃ।’ অম্ভৃণ ঋষির মেয়ে বাক বা অম্ভৃণি ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের দশম অনুবাকের এ ১২৫তম সূক্তে জানাচ্ছেন, ‘আমি একাদশ রুদ্র, অষ্ট বসু, দ্বাদশ আদিত্য এবং বিশ্বদেবতারূপে বিচরণ করি।’ এই সূক্তে ব্রহ্মশক্তি, রুদ্র, আদিত্য ও ইন্দ্র, অগ্নি, অশ্বিনী কুমারসহ বিশ্ব দেবতার সঙ্গে ব্রহ্মবিদুষী বাক নিজ অভিন্নতা ঘোষণা করেছেন!
দেবীসূক্তে মোট আটটি শ্লোক বা মন্ত্র আছে। প্রথম এবং তৃতীয় থেকে অষ্টম শ্লোক ত্রিষ্টুপ ছন্দে রচিত এবং দ্বিতীয় শ্লোক জগতী ছন্দে রচিত। মন্ত্রগুলোকে একত্রে বৈদিক দেবীসূক্তম বলে। সাধারণভাবে চণ্ডিপাঠের পূর্বে ঋগ্বেদের রাত্রিসূক্ত এবং পাঠান্তে দেবীসূক্ত পাঠ করা হয়।
‘অহং রাষ্ট্রী সংগমনী বসুনাম চিকিতুষী প্রথমা যজ্ঞিয়ানাম।
তাং মা দেবা ব্যদধুঃ পুরুত্রা ভূরিস্থাত্রাং ভূর্য্যাবেশয়ন্তীম্।
আমি জগতের ঈশ্বরী, ধনপ্রদায়িনী। ব্রহ্মকে জ্ঞাতা আমার আমিই যাঁদের জন্য যজ্ঞ করা হয় তাদের মধ্যে প্রথমা।
বহুরূপে সর্বভূতে প্রবিষ্টা সেই আমাকে বহুস্থানে বা সর্বদেশে আরাধনা করা হয়।’
( ঋগ্বেদ: দশম মণ্ডল, দশম অনুবাক, ১২৫তম সূক্ত, মন্ত্র ৩)
দেবীসূক্ত নিয়ে বেদের সবচেয়ে বিখ্যাত ও প্রাচীন ভাষ্যকার বা টীকাকার সায়ণাচার্য্য বলেছেন, অম্ভৃণ কন্যা বাক পরমাত্মার সাথে নিজের অভিন্নতা উপলব্ধি করে জগৎরূপে নিজেকে ব্রহ্ম উপলব্ধি করেছেন, যা ‘স্বাত্মানম অস্তৎ’। আবার ব্রহ্মরূপিণী ভগবতী এখানে ব্রহ্মবিদুষী বাককে যন্ত্ররূপে গ্রহণ করে তার ভিতর দিয়েই নিজের জগৎব্যাপী আত্মস্বরূপের পরিচয় দিয়েছেন।
বেদ সূত্রে বলা যায়, ব্রহ্মবাদিনী বাক অনুভব করেছিলেন সবই ব্রহ্মের অংশ এবং তিনি নিজের মধ্যে সমস্ত দেবতা, চরাচর বা বিশ্বকে ধারণ করে আছেন। এটি সরাসরিভাবে দেবীমহিমা নয়। কিন্তু নারী বা দেবীত্বের এই অনুভবকে কেন্দ্র করেই পরবর্তিতে শক্তিতত্ত্বের বিকাশ ঘটেছে।
বাক্-সূক্ত তাই প্রকৃতপক্ষে দেবীকেই ইঙ্গিত করে। কারণ বাকসূক্তে বাক যা বলেছেন তা স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দে এবং নিজেকে আদ্যাশক্তি দেবীর স্বরূপে বিবরণ দিয়ে স্তোত্র আকারে। বাক নিজেকে এই শক্তির সঙ্গে একাত্ম করেছেন। অদ্বৈতবাদ অনুসারে যে ব্রহ্মকে জ্ঞাত হয় তাকেই ব্রহ্ম স্বরূপ বলা হয়। বাক এই স্তোত্র রচনার মাধ্যমে আদ্যাশক্তি দেবীর স্বরূপ নিজের মধ্যেও প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাই তিনি ব্রহ্মস্বরূপা। তাই এটি দেবীসূক্ত।
দেবী সূক্তে নির্দিষ্ট করে কোন নাম বা উপাধি বিশিষ্ট দেবীর কথা বলা হয়নি। অর্থাৎ এখানে আদ্যাশক্তিকে নির্দিষ্ট কোন রূপেই সীমাবদ্ধ করা হয়নি। এটি দেবীর বিশ্বময় স্বরূপের প্রকাশ। এ সূক্তটি বেদোত্তর সাহিত্যেই বস্তুত দেবী-সূক্ত নামে অভিহিত হয়েছে। কারও কারও মতে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে যে দেবীশক্তি নিহিত রয়েছে, এই উপলব্ধি থেকেই পরে এই শক্তি নানা নামে শাক্তপূজার প্রধান উপাস্য দেবতায় পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে, মার্কন্ডেয় পুরানের দেবী মাহাত্ম্যে নারায়ণী স্তুতি শুরুর একটি শ্লোকে বলা হচ্ছে, ‘স্ত্রীঃ সমস্ত সকলা জগৎসু’ অর্থাৎ, প্রত্যেক স্ত্রী বা নারীর মধ্যেই জগৎ তথা দেবীসত্ত্বা বিরাজমান। অম্ভৃণি বা বাকও সেই আদ্যাশক্তি দেবীর স্বরূপে নিজেকে ব্রহ্মের সাথে একাত্ম করেছেন। জগতের সকল নারীরই সে অধিকার আছে, যেন ঘোষণা করেছেন সে কথাই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)