বাংলাদেশের কৃষিখাত দেশের অর্থনীতিতে মূখ্য ভূমিকা পালন, জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশের কর্মসংস্থান এবং বিশ্বজুড়ে চলমান যুদ্ধ-সংঘাত, মহামারী, জলবায়ু বিপর্যয়জনিত নানা অভিঘাত মোকাবেলা করে দেশের খাদ্য চাহিদার অব্যাহত যোগান তথা খাদ্য নিরাপত্তা বজায় রেখে চলেছে।
সারা পৃথিবী যখন অর্থনৈতিক মন্দার কবলে নিজেদের টাল-মাটাল অবস্থা থেকে উত্তরনের প্রচেষ্টায় লিপ্ত, তখন বাংলাদেশের অভাবনীয় অগ্রগতি যে কৃষির অভাবনীয় উন্নয়নের জন্যই ঘটছে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের কৃষির এই রূপান্তরের পেছনে রয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের দূরদৃষ্টি ও ধারাবাহিক বিনিয়োগ, কৃষিবিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন ও গবেষণা, সম্প্রসারণকর্মীদের মাঠ পর্যায়ের ভূমিকা এবং সর্বোপরি ফসলের মাঠে কৃষকের ঘাম ঝরানো পরিশ্রম।
সরকারের পাশাপাশি উন্নয়নমুখী কেন্দ্রীয় ব্যাংক উপযুক্ত কৃষিঋণ নীতিমালা প্রণয়ন, সবুজ কৃষির জন্য বিশেষ তহবিল গঠন, নারী উদ্যোক্তাসহ সবুজ উদ্যোক্তাদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের সুযোগ সৃষ্টির কথাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সকলের এই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের কৃষি আজ খোরপোশ কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হয়েছে। কিছুদিন আগেও ভয়াবহ করোনাকালে সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়ার ফলে কৃষি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল এবং তাৎক্ষণিকভাবে সরকার দ্রুত প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছিল বলেই কৃষির আজকের এ উন্নতি সম্ভব হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীরা নিত্যনতুন উদ্ভাবন ও মাঠ পর্যায়ে গবেষণায় নিজেদেরকে যেভাবে নিয়োজিত রেখেছেন তাও আমাদের মনে রাখতে হবে। তাছাড়া, কৃষিপণ্যের সংরক্ষণ, সোলার ইরিগেশন পাম্পের প্রসার এবং ই-কমার্সের মাধ্যামে কৃষির সম্প্রসারণের চ্যালেঞ্জসমূহ উত্তরনের ভূমিকাও কম নয়।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জের শিকার প্রথম সারির দেশ। তা ছাড়া কভিডের প্রভাবে সারের উৎপাদন যেভাবে কমে গেছে, তাতে কৃষির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সাম্প্রতিক ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও বিশ্ব খাদ্য বাজারকে ওলটপালট করে দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে।
বাংলাদেশ সার, গম ও ভোজ্য তেল সংগ্রহে বেশ চাপেই আছে। এর মাঝে বিএনপি-জামাত জোটের চলমান নেতিবাচক রাজনৈতিক কর্মসূচী যেন ‘মড়ার উপর খাড়ার ঘা’। লাগাতার অবরোধ-হরতাল তথা যত্রতত্র গাড়ীতে অগ্নিসংযোগ-ভাংচুরের ফলে কৃষিতে বিধ্বংসী প্রভাব পড়ছে এবং কৃষির অব্যাহত অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
বর্তমান সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে কৃষিখাতকে ভগ্নদশা থেকে উত্তরণের জন্য কৃষকরা কঠোর পরিশ্রম করে কৃষিকে একটা পর্যায়ে উন্নীত করতে পেরেছে যা আবারও অবরোধ-হরতালে ভেঙ্গেপড়ার মতো অবস্থায় উপনীত হয়েছে যা কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না।
হরতাল-অবরোধের ফলে যথা-সময়ে তাদের এসব উপকরণ প্রাপ্তিতে বিঘ্ন ঘটে ফলে থমকে যায় তাদের স্বপ্ন। উপকরণ সমূহের মধ্যে আছে বীজ, সার, বালাইনাশক, তাছাড়াও আছে শ্রমিকের ঘাটতি যা এসব নেতিবাচক কর্মসূচীর মাধ্যমে বিঘ্নত হয়। হরতাল অবরোধে কৃষিপণ্য বা কৃষি উপকরণ নির্বিঘ্নে চলাচল করতে দেওয়া না হলে দেশে খাদ্য সংকট দেখা দিবে। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের কোটি কোটি কৃষক। যার প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে।
ধর্মঘট-অবরোধে খামার থেকে বাজারে কৃষি পণ্য পরিবহনে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে বিলম্ব হয় পরিবহন, পরিবহন খরচও বেড়ে যাচ্ছে। ফসল সংগ্রহোত্তর ক্ষতির সম্মূখীন হচ্ছে কৃষক। চলতি মৌসুমে জেলার ৯ উপজেলায় ৫৭১ হেক্টর জমিতে পেঁপে চাষ হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই পেঁপে সরবরাহ করা হয়। অবরোধের কারণে প্রায় লক্ষাধিক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে জানিয়েছে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। চাষিরা জানান, স্বাভাবিক সময়ে ৪০ টাকা কেজি দরে পেঁপে বিক্রি হলেও এখন ২০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। আবার অনেক মালিক বিক্রি করতে না পারায় বাগানেই পেঁপে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
অবরোধ-ধর্মঘটের সময় কৃষকরা তাদের পণ্য বিক্রি করার জন্য বাজারে প্রবেশে করতে বাধার সম্মূখীন হচ্ছেন। এটি তাদের আয়কে মারাত্বকভাবে প্রভাবিত করছে। ঈশ্বরদীসহ দেশের অনেক উৎপাদন জোনে শত শত টন আগাম শীতকালীন সবজি খেতেই নষ্ট হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, চলতি মৌসুমে গোদাগাড়ীতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমিতে আগাম জাতের শীতকালীন টমেটোর চাষ হয়েছে। প্রায় এক মাস আগে জমি থেকে টমেটো তোলা শুরু হয়। কিন্ত চলমান অবরোধে পরিবহন বন্ধ থাকায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলায় টমেটো সরবরাহ করতে পারছেন না ব্যাবসায়ীরা।
কৃষি বিভাগসহ স্থানীয় হিসাবে প্রতিবছর রাজশাহীর গোদাগাড়ীর কৃষকেরা প্রায় ৪০০ কোটি টাকার টমেটো বিক্রি করেন। এবার তার চার ভাগের এক ভাগ, অর্থাৎ ১০০ কোটি টাকাও বিক্রি করতে পারবেন কি না সন্দেহ। প্রতিবছর এই সময়ে যেখানে গোদাগাড়ীতে টমেটোচাষিদের মধ্যে উৎসব দেখা যেত, এখন সেখানে বিরাজ করছে চরম হতাশা।
হরতাল-অবরোধের কারণে দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলোয় সার ও ডিজেলের সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী নৌবন্দর থেকে উত্তরবঙ্গের ১৬টি জেলায় সার সরবরাহ বন্ধ থাকায় বাঘাবাড়ী বন্দরে খোলা আকাশের নিচে হাজার হাজার টন ইউরিয়া সার পড়ে থাকতে দেখা যায়।
এখন দেশের সব এলাকায় বোরো বীজতলা তৈরি ও রোপণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় এবং সারের চাহিদা সর্বোচ্চ। কিন্তু হরতাল-অবরোধের কারণে সার পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে। আমদানি করা প্রচুর পরিমাণ সার পড়ে আছে দেশের বৃহত্তম দুই সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ও মংলায়।
টানা অবরোধের কারণে সারা দেশে বিঘ্নিত হচ্ছে জ্বালানি তেল সরবরাহ কার্যক্রম। একই সঙ্গে কমেছে বিক্রিও। নৌপথে সরবরাহ ব্যবসা চালু থাকলেও গত এক মাসে সাপ্তহিক ছুটির দিন সড়ক ও রেলপথে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধই ছিল বেশি।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের হিসাবে চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গায় অবস্থিত জ্বালানি তেলের প্রধান ডিপো থেকে এক দিনের অবরোধে দেশের ডিপোগুলোয় গড়ে ১৬ থেকে ১৮ হাজার মেট্রিক টন জ্বালানি তেল সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সেচনির্ভর বোরো মৌসুমের ওপর।
হরতাল-অবরোধের আরেক ধরনের ক্ষতি হচ্ছে, দেশের ভাবমুর্তির ক্ষতি। কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং নিয়ে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সারা বিশ্বে বাংলাদেশ নানা ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করেছে। বিগত দেড়-দশক ধরে সরকার যখন বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের সুন্দর পরিবেশ সম্পর্কে একটি ইতিবাচক চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে; আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়রা যখন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশংসা করছে; ইকোনমিস্ট ইন্টেরিজেন্স ইউনিট যখন পূর্বাভাস দিচ্ছে যে, বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে বিশ্বের ২০তম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে; তখন, হরতাল-অবরোধের মতো ধ্বংসাত্বক কর্মসূচি বিদেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে।
তাই অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে অগ্রাধিকার বিবেচনায় নিয়ে সবাইকে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচির থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। তাদের কাছে আমাাদের একটাই প্রত্যাশা, ব্যবসা করতে পারেন এবং সাধারণ মানুষ যেন নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারে সেদিকে সকলকে নজর দিতে হবে। হরতাল-অবরোধের মতো ধ্বংসাত্বক কর্মসূচী পরিহার করে স্মার্টকৃষির পরিপূর্ণ বিকাশ আমরা দেখতে চাই বর্তমানে এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)
বিজ্ঞাপন