২০০১ থেকে ২০০৬ সাল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বিএনপি জামায়াত জোট সরকার। দেশজুড়ে উত্থান হয় হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ- হুজিবি, জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ – জেএমবিসহ বেশকিছু জঙ্গি সংগঠনের।
দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করে জেএমবি। সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধান সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন উত্তরের কয়েকটি জেলায়। নওগাঁর রানিনগর আত্রাইসহ আশপাশের কয়েকটি উপজেলায় অরাজকতার পর সর্বহারা দমনের নামে বাংলা ভাই আস্তানা করেন রাজশাহীর বাগমারা এলাকায়। অভিযোগ আছে রাজশাহী অঞ্চলে বাংলা ভাইকে মদদ দিয়েছিলেন বিএনপির সংসদ সদস্য নাদিম মোস্তফা এবং রাজশাহীর সে সময়ের পুলিশ সুপার মাসুদ মিয়া।
বাগমারা এলাকায় বেশ কয়েকটি টর্চার সেল খোলেন বাংলা ভাই। বিভিন্ন মানুষকে তুলে এনে অকথ্য নির্যাতন করেন বাংলা ভাই ও তার দোসররা। হত্যা করেন অনেককে। নির্দিষ্ট অংকের চাঁদা দিয়ে মুক্ত হন কেউ কেউ। বেঁচে যাওয়া অনেকেই পঙ্গু হয়ে যান জীবনের তরে। এসব নিয়ে গণমাধ্যমগুলোতে যখন তোলপাড়- জোট সরকারের মন্ত্রী যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী মন্তব্য করেন- বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি।
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলার ৫০০ এর বেশি স্থানে একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেদের শক্ত অস্তিত্ব জানান দেয় জেএমবি। আদালতের এজলাসে বোমা হামলা চালিয়ে হত্যা করে দুই বিচারক সোহেল রানা এবং জগন্নাথ পাঁড়েকে।
গণমাধ্যমগুলোতে একের পর এক প্রতিবেদন এবং দেশি বিদেশি কড়া সমালোচনার মুখে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে গ্রেফতার হয় বাংলা ভাই। সিলেটের সূর্যদীঘল বাড়ি থেকে গ্রেফতার হয় জেএমবির আমির শায়খ আবদুর রহমান।
২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্দরে ধরা পড়ে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অবৈধ অস্ত্রের চালান। দশ ট্রাক অস্ত্র চট্টগ্রাম বন্দরে খালাসের সময় আটক করে ফেলেন পুলিশের দুই সার্জেন্ট। আর এরজন্য তাদের গুনতে হয় কড়া মাশুল। দুইজনকেই চাকরিচ্যুত করে রিমান্ডে নিয়ে করা হয় ব্যাপক নির্যাতন। ধামাচাপার চেষ্টা হয় দশ ট্রাক অস্ত্র। পরে দেখা যায় দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের পেছনের কারিগর ছিলেন বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের মন্ত্রী এমপিরা।
২০০৪ সালের একুশে আগস্ট। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাসে নৃশংসতম কালো দিন। ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করে হত্যা করা হয় ২৪ জন নেতাকর্মীকে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাসহ আহত হোন বহু নেতাকর্মী। শুধু বর্বর গ্রেনেড হামলাই নয়, পরবর্তীতে মর্মান্তিক এই হামলার আলামত নষ্টের নগ্ন চেষ্টা করে বিএনপি জামায়াত জোট।
রাজধানীর থানায় থানায় ঘুরলেও আওয়ামী লীগের মামলা নেয়নি পুলিশ। ঘটনাকে ভিন্নখাতে নিতে মঞ্চস্থ করা হয় জজ মিয়া নাটক। নোয়াখালীর সেনবাগের নিরীহ যুবক জজ মিয়াকে বানানো হয় হামলার মূল কারিগর। আর প্রকৃত হামলাকারীদের সরকারির মদদে পাঠিয়ে দেয়া হয় দেশের বাইরে। পরে তদন্তে উন্মোচিত হয় থলের বিড়াল। বের হয়ে আসে গ্রেনেড হামলার পেছনের রাঘব বোয়ালদের নাম।
একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর সংসদে দাঁড়িয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন- আওয়ামী লীগ সভাপতি ভ্যানেটি ব্যাগে করে বোমা নিয়ে সমাবেশে ফাটিয়েছেন। ঘটনার প্রায় দুই দশক পর একই সুরে কথা বলছেন বিএনপি মহাসচিব। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলো হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ – হুজি’বি।
২০১৬ সালে নৃশংসতা বিবেচনায় দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংস জঙ্গি হামলা ঘটে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয়। এই হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গি বিরোধী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করলে, একেও নাটক হিসেবে মন্তব্য করে বিএনপি।
এর আগে ২০১৩ থেকে ১৫- দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমা বিস্ফোরণ ও একের পর এক টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনা ঘটছিলো। ঢাকার গুলশানে ইতালীয় নাগরিক তাভেলা সিজারকে হত্যার মধ্যদিয়ে টার্গেট কিলিংয়ের সূচনা। এরপর রংপুরে জাপানি হোসে কুনিও হত্যা থেকে শুরু করে দেশের নানা প্রান্তে একের পর এক হত্যার ঘটনা ঘটতে থাকে।
ধর্মীয় নেতা, মন্দির মসজিদ কিছুই বাদ যায়নি উগ্রবাদীদের নিশানা থেকে। এছাড়া মুক্তমনা লেখক প্রকাশক ব্লগার অনেকেই হত্যার শিকার হন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বরাতে উঠে আসে লেখক ব্লগার হত্যা ও হামলার সঙ্গে জড়িত ছিলো আনসার আল ইসলাম। যারা আলা কায়েদার মতাদর্শে বিশ্বাসী। অন্যদিকে মসজিদ মন্দিরে হামলা এবং ধর্মীয়গুরুদের হত্যার পেছনে ছিলো নব্য জেএমবি। যারা আইএস মতাদর্শে বিশ্বাস করে।
পুরনো ধারার জেএমবি এবং হরকাতুল জিহাদসহ বিভিন্ন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের দলছুট সদস্যরাই এই দুটি ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দাবি করে।
সচেতন মানুষের নিশ্চয়ই মনে আছে ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের একের পর এক হত্যা নাশকতা এবং ২০১৬ সালের হলি আর্টিজান হামলা- প্রত্যেকটি ঘটনা ঘটার সঙ্গেই দায় শিকার করে বিবৃতি আসতো সাইট ইন্টেলিজেন্স নামের একটি ওয়েব সাইট থেকে। যেটির প্রধান নির্বাহী রিটা কার্টজ এক সময় কাজ করেছেন ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হয়ে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি পরিচত নাম মেন্দি এন সাফাদি। মোসাদের এজেন্ট হিসেবে তার পরিচিতি। পাঠকের কি মনে আছে এই নামটি বাংলাদেশে প্রথম কখন শোনা গেছে? বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরী সাফাদির সঙ্গে বৈঠক করেছেন এমন খবর প্রকাশের পর গ্রেফতারও হয়েছিলেন তিনি। সুতরাং নব্য জেএমবি কিংবা আনসার আল ইসলামের একের পর এক অপতৎরতা, সেটি আবার সাইট ইন্টেলিজেন্সে প্রকাশ হওয়া এবং আসলাম চৌধুরীর মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বৈঠক করা- কোনো যোগসূত্র মেলে কি?
জঙ্গিবাদ নিয়ে ভাবেন, এমন ব্যক্তিরা বরাবরই বলেন, রাজনৈতিক মদদ না পেলে জঙ্গিবাদ কখনো ডানা মেলতে পারে না। ২০০১ থেকে ২০০৬ জোট সরকারের আমলে জঙ্গিদের রাজনৈতিক মদদ পাওয়ার বিষয়টি এখন স্পষ্ট। কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখা যায় জঙ্গিবাদ বিষয়ে বর্তমান সরকারের শূন্য সহিষ্ণুতা নীতির পরেও ২০১৩ থেকে ২০১৫ জঙ্গিদের ব্যাপক তৎপরতা ছিলো। কেন ছিলো? প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর আছে। ২০১৩ আর ২০১৫ এর মাঝখানে ২০১৪ সাল। পাঠট নিশ্চয় ভুলে যাননি ২০১৪ সাল ছিলো নির্বাচনের বছর। আর এই নির্বাচন বর্জন করে কারা প্রতিহতের ঘোষণা দিয়েছিলো। এবং দেশে আন্দোলনের নামে অরাজকতা কারা করেছিলো?
এবার আসি হলি আর্টিজান প্রসঙ্গে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজান হামলা ঘটে। তখন রাজনৈতিক আন্দোলন থেমে গেলেও এর পেছনে রাজনৈতিক মদদ ছিলো কি? প্রশ্নটা তোলা থাকলো আগামী সময়ের জন্য।
কিন্তু হলি আর্টিজান হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন। অভিযানে মারাও গেছেন অনেক জঙ্গি। সব মিলিয়ে বলা যায় জঙ্গিবাদ এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু এনিয়ে আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। কারণ অনুকুল পরিবেশ পেলে জঙ্গিরা যেকোনো সময় মাথাচারা দিয়ে উঠতে পারে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)