বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শান্তা। রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখে শঙ্কিত থাকেন। ভাবেন কখন কী হয়? বিএনপি’র আগুন সন্ত্রাসের ঘটনা তার জানা। সেই সময় কীভাবে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা হতো সেই ঘটনাও তার জানা। জানা তার বাবা-মায়েরও। তাই তারা মেয়েকে ঢাকায় পড়তে পাঠিয়ে ভয়ে থাকেন। বাড়ি থেকে একের পর এক ফোন আসে। কখন, কোথায় আছে জানাতে হয় বাবা-মাকে। মেয়েদের হোস্টেলে থাকেন শান্তা। ভয়ে বের হয় না। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ক্লাস থাকলেও মাঝে মাঝে যেতে ভয় পান।
টঙ্গীর ফুটপাতে নিয়মিত বসেন সবজি বিক্রেতা আম্বিয়া। বেলা ১২টার দিকে সবজি নিয়ে বসেছেন। ২৮ তারিখ হরতালের সারাদিন মিলিয়ে ৩০০ টাকার সবজি বিক্রি করতে পারেননি। কীভাবে চলবেন বুঝতে পারছেন না। দৈনিক আয়ের সাধারণ মানুষ আম্বিয়া একা নন, অসংখ্য। রাজনৈতিক অস্থিরতায় তারা পড়েন বিপাকে। তারা রাজনীতি বোঝেন না, বোঝেন পেট নীতি।
দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এখন চলমান। ২৮ অক্টোবর বিএনপির হরতাল এবং ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত অবরোধে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা সবার মধ্যেই অস্থিরতা কাজ করছে। কখন কী হয়।
স্কুল বন্ধ, দোকান বন্ধ, চলাচলে অসুবিধা। সবকিছু মিলিয়ে শান্তি উধাও হয়ে গেছে। গোটা বিশ্বে অর্থনৈতিক অস্থিরতা চলছে। অর্থনীতি গতিশীল ও স্থিতিশীল করার জন্য সবাই উঠে পড়ে লেগেছে সেই জায়গায় বিএনপি হাঁটছে উল্টো পথে।
বিএনপির সমাবেশ ঘিরে শনিবারের সংঘর্ষ এবং রোববারের হরতালে বাস ভাঙচুর, আগুন দেওয়া এবং বাস ডিপোতে হামলায় ৮৮ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিসি)। এই ৮৮ কোটি টাকা কার? বিআরটিসি? না। এই ৮৮ কোটি টাকা জনগণের। জনগণের টাকায় কেনা সরকারি বাসের যে ক্ষতি তা কে দেবে?
২৮ অক্টোবর বিএনপির ডাকা একদিনের হরতালে দেশের অর্থনীতিতে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) ২০১৩ সালের এক জরিপে দেখা যায়, সেই সময়ে একদিনের হরতালে পোশাকখাত, পরিবহনখাত, পাইকারি-খুচরা ব্যবসা, আমদানি-রফতানি ও রাজস্ব আয় মিলিয়ে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বা ২০ কোটি মার্কিন ডলার (তৎকালীন ডলারের হিসাব অনুযায়ী) ক্ষতি হতো।
বর্তমানে এই ক্ষতির পরিমাণ আরও বেড়েছে। শুধু ক্ষতি বেড়েছে বললে ভুল বলা হবে, এই সময় সারা বিশ্বের অর্থনীতি অস্থিতিশীল, রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট, মধ্যপ্রাচ্য হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ সবকিছু টালমাটাল করে রেখেছে। তার মধ্যে করোনা পরবর্তী সংকট এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি অনেক দেশ, সেই জায়গায় রাজনৈতিক অস্থিরতা মানে অর্থনৈতিক সংকট এবং সেই অর্থনীতি নির্ভর মানুষগুলোর অভাব-অনটন চরমে ওঠে।
২০১১ সালের জুলাই মাসে টানা ৬ দিন চলা হরতাল নিয়ে জাতিসংঘের উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা ইউএনডিপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, তখনকার ৬ দিনের হরতালে দেশে ২০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। প্রতিটি হরতালে জিডিপির গড় ক্ষতি ছিল সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। একই প্রতিবেদনে বলা হয়, হরতালের কারণে দেশের মোট অর্থনীতির ২০ শতাংশ ক্ষতির মুখে পড়ে। এছাড়া আমদানি-রফতানিতে এই ক্ষতির পরিমাণ ১০ শতাংশ এবং শুধু একদিনের হরতালের কারণে দেশে পণ্যমূল্যের দাম বাড়ে ১০ শতাংশ।
২০১১ সালের দেশের অর্থনীতি যেখানে ছিল এখন সেই জায়গায় নেই। এখন অর্থনীতির আকার বড় হয়েছে, এর সাথে যুক্ত হয়েছে অসংখ্য মানুষ। সেই বৃহৎ অর্থনীতি যখন অস্থিতিশীল হবে তখন তার ধাক্কা সব জায়গায় পড়বে। রাজনৈতিক অস্থিরতা শুধু যে অর্থনীতি ধ্বংস করে তা নয়, আরও অনেককিছু ধ্বংস করে। বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে দুষ্কৃতিকারীদের হামলায় বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ২৫ জন সদস্য আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে দুইজনের অবস্থা গুরুতর। দিনভর চলা রাজনৈতিক আন্দোলনের সহিংসতায় ২২ জায়গায় অগ্নিকাণ্ডের সংবাদ পেয়েছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স। এর মধ্যে ১২ জায়গার আগুন ফায়ার সার্ভিস নির্বাপণ করেছে।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে বিএনপি নেতাকর্মীদের হামলায় তিন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে দুইজনকে কুপিয়ে জখম করা হয়েছে। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, পুলিশ কনস্টবল আমিরুল ইসলাম পারভেজ এর মৃত্যু। ২৮ অক্টোবর তাকে যেভাবে পিটিয়ে মারা হলো তা ভয়াবহ এবং বীভৎস। এই বীভৎসতা কাম্য নয়।
আমিরুলের মেয়ে তানহাকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে শুক্রবার (২৭ অক্টোবর) রাত তিনটার দিকে ডিউটি করতে বাসা থেকে বের হন পুলিশ কনস্টবল আমিরুল ইসলাম পারভেজ (৩৩)। শনিবার (২৮ অক্টোবর) রাজধানীর দৈনিক বাংলা মোড়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে গুরুতর আহত হন তিনি। তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
রাজনৈতিক সহিংসতার বলি আমিরুল। তার মেয়ে তানহা এখন কাকে বাবা ডাকবে? এর উত্তর কি আছে কারও কাছে?
দেশ স্থিতিশীল করার জন্য, মানুষের মনে ভয় দূর করার জন্য এখনই বিএনপির রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে বের হয়ে আসা উচিত।
(এই বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)