দিনাজপুর শহরের নিমতলা মন্দির মোড়। পিঠা-পুলির মিষ্টি ঘ্রাণে মোহিত এলাকাটি। এখানে শীতের পিঠা বানিয়ে যেমন অনেকের ভাগ্য বদল হয়েছে, তেমনই পিঠা-পুলি খেয়ে অনেকে স্বাদ পেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছে।
শীত এলেই এই মোড়টিতে জমে উঠে পিঠা বিক্রির ধুম। ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, পাটিসাপটা ও তেলের পিঠার ধোঁয়া আর সুগন্ধি মিষ্টি ঘ্রাণে সন্ধ্যার পর মোহিত হয়ে উঠে এলাকাটি। কুয়াশামোড়ানো শীতের হিমেল হাওয়ায় ধোঁয়া উঠা পিঠার স্বাদ না নিলে যেন তৃপ্তি মেটে না অনেকের।
সন্ধ্যা হলেই সারিবদ্ধ চুলার ধোঁয়া উড়ছে। ক্রেতারা এসে সারিবদ্ধ হয়ে পিঠা কিনছেন, খাইছেন—এই দৃশ্য চলে গভীর রাত পর্যন্ত।
শহরের যান্ত্রিক জীবনে অনেকের সময় নেই বাড়িতে পিঠা তৈরির। তাই নির্ভর এসব পিঠার দোকানেই। শীতের পিঠার স্বাদ নিতে তাই এইসব দোকানে ধুম পড়ে পিঠা বেচা-কেনার। এসব পিঠা বিক্রি করে অনেকের ভাগ্য বদল হয়েছে। হয়েছেন স্বাবলম্বী। পেয়েছেন আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ। নারীরাও সংসারে অর্থ যোগান দিতে বেছে নিয়েছেন এখানে পিঠা তৈরির কাজ।
তবে তীব্র শীতের প্রকোপে ক্রেতা কমেছে বলে জানালেন পঞ্চাশোর্ধ সহিদা বেগম। তার ভাই ওয়াহেদসহ তিনি এখানে পিঠা তৈরি ও বিক্রি করেন।
সহিদা বলেন, ‘কমি গেইছে বা বেচা-বিক্রি। মানুষ আইসা কমি গেইছে।যে ঠাণ্ডা মানুষ ঘর থাকি বাইর হবার চায় না। মানুষ না আসিলে খাবি কে, কহেন! আগের মতো আর বিক্রি নাই।’
শুধু সহিদা নয়, দিনাজপুর শহরের এই নিমতলায় ৮ জন শীতের পিঠার দোকান করেন।
পিঠা বিক্রেতা ষাটোর্ধ আব্দুল মান্নান জানালেন, তিনি আগে ঠেলা গাড়ি চালাতেন।এই নিমতলা মোড়েই তারা ১৫-২০ জন ঠেলাগাড়ি নিয়ে বসে থাকতেন। স্থানটি এক সময় দিনাজপুরের একমাত্র ঠেলাগাড়ি স্ট্যান্ড ছিল। কালের বিবর্তনে সেই ঠেলা গাড়ি হারিয়ে গেছে। তাই তিনি বেকার হয়ে পড়েছিলেন। কোন কাজ না থাকায় অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তাকে। হঠাৎ তার মাথায় বুদ্ধি আসলে পিঠা তৈরির দোকান দিয়ে বসেন। ১৭-১৮ বছর ধরে পিঠা বিক্রি করে আব্দুল মান্নানের ভাগ্য বদল হয়েছে। নিজে জমি কিনে বাড়ি দিয়েছেন। আরো কিছু আবাদি জমি কিনেছেন। মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন।
মান্নান আরও বলেন, সন্ধ্যার আগে আসি। গভীর রাতে বাড়ি ফিরি। প্রতিদিন ৮-১০ হাজার টাকার পিঠা বিক্রি হয়। লাভ মোটামুটি ভালোই থাকে। এখানে আমার ছেলেসহ আরও দু-তিনজন কাজ করে। তবে আগের মতো আর বেচা-বিক্রি নাই। এখন অনেক পিঠার দোকান হইছে।
অল্প পুঁজি আর কম পরিশ্রমে বেশি লাভ হওয়ায় পিঠা ব্যবসায় নেমেছেন অনেকেই।
শুধু নিমতলা মন্দির মোড় নয়, বাঞ্জারাম ব্রীজ, থানা মোড়, বটতলী, কাঞ্চন ব্রীজ মোড়, পুলহাট, ফুলবাড়ী বাস স্টান্ড, শেরশাহ ব্রীজ, মহারাজা মোড়, চাউলিয়াপট্রি মোড়সহ বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট পিঠার দোকান সাজিয়ে বসছে নারী-পুরুষ বিক্রেতারা। অনেকেই এই শীতের মৌসুমে পিঠা বিক্রিকে বেছে নিয়েছেন মৌসুমী পেশা হিসেবে। বেচা-কেনাও বেশ ভালোই চলে।
নিমতলা মোড়ে দাঁড়িয়ে পিঠা খেতে খেতে বিরল স্থলবন্দর কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাসিম জানালেন, ‘আমরা প্রায়ই এখানে পিঠা খাই। পরিবারের জন্য বাসায় পিঠা নিয়ে যাই। আজ বৌকেও সঙ্গে এনেছি। কর্মব্যস্ততার কারণে বাড়িতে চাল ভেঙে আটা করে পিঠা বানানোর সময় সুযোগ আর হয়না। ঝামেলা ছাড়াই স্বল্প দামে হাতের নাগালেই এখন পিঠা পাই। তাই এখন পথের ধারে পিঠাই আমাদের ভরসা।’
পিঠা কিনতে আসা জিনিয়া রহমান বলেন, আমি প্রতিদিনই সন্ধ্যার পর এই এখানে পিঠা খাই। শীতকালের খাবার মধ্যে পিঠা অন্যতম। আগে যদিও বাড়িতে এসব পিঠা বানানোর হিড়িক পড়তো এখন তা আর দেখা যায় না, কর্মব্যস্ততায়।
পিঠা বিক্রেতা ওয়াহেদ জানালেন, ‘ভাপা পিঠা তৈরির উপকরণ হচ্ছে চালের গুড়, নারকেল, খেজুরের গুড়। গোল আকারে পাতিলে কাপড় পেঁচিয়ে ঢাকনা দিয়ে হাঁড়ির ফুটন্ত গরম পানিতে ভাপ দিয়ে তৈরি হচ্ছে ভাপা পিঠা। অন্যদিকে, চালের গুড়ো পানিতে মিশিয়ে মাটির বাসনে তৈরি করা হচ্ছে চিতই পিঠা।’
কয়েকদিন ধরে দিনাজপুরে তীব্র শীত। বিশেষ করে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় কনকনে শীত। এমন পরিবেশে শীতের পিঠা খেতে অনেকে পছন্দ করছেন। সন্ধ্যার হিমেল হাওয়ায় খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে পিঠা খেতে অনেকেই ভিড় জমাচ্ছেন নিমতলা মোড়ে ভ্রাম্যমাণ পিঠার দোকানগুলোতে। এর মধ্যে ভাপা আর চিতই পিঠার কদর বেশি।
শীতের তীব্রতাকে হার মানিয়েছে শীতের পিঠা। প্রচণ্ড শীতে জবুথবু মানুষগুলো শীতকে উপেক্ষা করে পিঠা খেতে ছুটছে দোকানগুলোতে। শীতের এই পিঠে উৎসবকে ঘিরে শহরের চিত্রটাও ভিন্ন। ধানের জেলা দিনাজপুরের অলিতে গলিতে, মোড়ে-মোড়ে জমে উঠেছে এসব শীতের পিঠার দোকান। রাস্তার দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে তাই অনেককেই দেখা যাচ্ছে পিঠা খেতে।
২২ বছর ধরে পিঠা বিক্রি করেন শহরের বাসস্টান্ড এলাকার মজিবর। তিনি জানান, ভাপা পিঠা আর চিতই পিঠা প্রতিটি ১০ টাকা করে বিক্রি করেন তিনি। প্রতিদিন ২ শতাধিক পিঠা বিক্রি হয় তার।